হাজি বাবার সফর শুরু, তুর্কমেনদের সাথে মোকাবেলা ও তার বন্দিদশা
সফরের জন্যে প্রস্তুত হওয়া আমাদের কাফেলায় খচ্চর এবং ঘোড়া মিলিয়ে প্রায় পাঁচশো পশু আর দুইশো উট ছিল।

সফরের জন্যে প্রস্তুত হওয়া আমাদের কাফেলায় খচ্চর এবং ঘোড়া মিলিয়ে প্রায় পাঁচশো পশু আর দুইশো উট ছিল।
জেমস জাস্টিনিয়ান মোরিয়ার
অনুবাদ: ফারহান মাসউদ
বুখারা থেকে আমদানি করা ভেড়ার চামড়া কেনার জন্যে আমার মনিব ওসমান আগা মেশেদ এর দিকে সফর শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। [বর্তমান ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মাশহাদ। – অনুবাদক] কেনার পরে সেই চামড়া বিক্রি করার জন্যে কনস্টান্টিনোপলে নিয়ে যাওয়াটাই ছিল তার ইচ্ছা। বিশাল মাথাওয়ালা স্থূল আর খর্বকায় একজন মানুষের কথা চিন্তা করুন, যার চোখে পড়ার মত ফোলা একটা নাক আর মুখভর্তি ঘন কালো দাড়ি রয়েছে; তাহলেই সফরে আমার সঙ্গী মানুষটাকে কল্পনায় আনতে পারবেন। তিনি ছিলেন খাঁটি একজন মুসলমান, যিনি কঠোরভাবে দীনদারি আঞ্জাম করতেন। ঠিকঠাকভাবে ওজু সারার জন্যে তীব্র শীতের সকালেও তিনি নিজের মোজা খুলে পা ধুতেন। তবে আলী’র সম্প্রদায়কে (শিয়াদেরকে) তিনি প্রচণ্ড ঘৃণা করতেন। আর এই নফরত তিনি নিজের মধ্যেই পুষে রাখতেন। অন্তত যতক্ষণ তিনি পারস্যে থাকতেন, ততক্ষণ তো বটেই। মুনাফার প্রতি মোহাব্বত ছিল তার চরিত্রের সবচেয়ে বড় গুণ। তার টাকাপয়সা নিরাপদ কোথাও রাখা হয়েছে কিনা, সেই ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি কখনোই ঘুমাতে যেতেন না। মোটের ওপর তিনি নিজের জন্যে সবসময়ই আরাম খুঁজে বেড়াতেন, একটানা ধূমপান করতেই থাকতেন, প্রচুর খাওয়াদাওয়া করতেন আর গোপনে শরাব পান করতেন। যদিও, যারা প্রকাশ্যে শরাব পান করে, তাদেরকে অভিশাপ দিয়ে বলতেন যে, তারা অনন্তকালের জন্যে দোজখে নিক্ষিপ্ত হবে।
আমাদের কাফেলার সফর শুরু হওয়ার কথা ছিল বাহারে (বসন্তে)। তাই আমরা সেই অনুসারেই প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি। সফরে চড়ার জন্যে আমার মনিব শক্তপোক্ত এবং চলনসই একটা খচ্চর সাথে নিয়েছিলেন। আর আমাকে দেয়া হয়েছিল একটা ঘোড়া। (যেহেতু তিনি পারস্যে প্রচলিত কায়দায় ধূমপানে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন তাই) আমি ছাড়াও যেই ঘোড়ার পিঠে চাপানো হয়েছিল একটা কালিয়ান [অনেকটা ভারতের হুক্কার মত করে তৈরি পারস্যের তামাক খাওয়ার পাইপ। – লেখক], আগুন জ্বালানোর একটা পাত্র, পানি বহনের চামড়ার থলে, কাঠকয়লা আর আমার কাপড়চোপর। আমাদের সাথে থাকা হাবশি দাসের জন্যে আলাদা আরেকটা খচ্চর দেওয়া হয়েছিল, যেটার পিঠে আমাদের বিছানাপত্র, গালিচা এবং রান্নার জন্য প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র স্তূপ করে রাখা হত। হাবশি এই খাদিম আমাদের জন্যে রান্নাবাড়া করত, গালিচা বিছাতো আর হায়ওয়ানগুলির পিঠ থেকে বোঝা ওঠানো-নামানো করত। তৃতীয় আরেকটা খচ্চরের পিঠে মনিবের কাপড়চোপড়ে বোঝাই দুটি বাক্সসহ আর সব জরুরি জিনিসপত্র চাপানো হয়েছিল।
সফর শুরু হওয়ার আগের দিন দূরদর্শী ওসমান তার বিরাট পাগড়ির কিনারের দিকে সেলাই করে ৫০ ডুকাট লুকিয়ে রেখেছিলেন। [মধ্যযুগ থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপ এবং মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত মুদ্রার নাম ডুকাট। – অনুবাদক] বিপদের কথা চিন্তা করে লুকিয়ে রাখা এই মুদ্রার ব্যাপারে তিনি আর আমি ছাড়া অন্য কেউই জানত না। আর তার বাদবাকি সব টাকাপয়সা সাদা চামড়ার তৈরি ছোট ছোট থলেতে ভরে কাপড়চোপরভর্তি বাক্সের একেবারে মাঝখানে রেখে দিয়েছিলেন।
সফরের জন্যে প্রস্তুত হওয়া আমাদের কাফেলায় খচ্চর এবং ঘোড়া মিলিয়ে প্রায় পাঁচশ পশু আর দুইশ উট ছিল। এগুলির মধ্যে বেশিরভাগ জানোয়ারের পিঠই বোঝাই হয়ে ছিল পারস্যের উত্তরাঞ্চলে নিয়ে যাওয়ার জন্যে হরেক রকমের মাল-সামানা দিয়ে। সওদাগর, তাদের খিদমতগার এবং কাফেলা পরিচালনা করার জন্যে কিছু লোকসহ কাফেলায় মানুষের সংখ্যা ছিল মোটামুটি দেড়শ জন। তবে এরা বাদে মেশেদ-এ থাকা ইমাম রেজার মাজার জিয়ারত করার জন্যে তীর্থযাত্রীদের ছোট্ট একটা দলও ছিল আমাদের সঙ্গে। [ইমাম রেজা দ্বাদশবাদী শিয়াদের বারো ইমামের মধ্যে অষ্টম ইমাম। – অনুবাদক] তারা সাথে থাকায় কাফেলায় একধরনের পাকপবিত্র ভাব এসেছিল আর তীর্থযাত্রীরাও খুশিমনেই এই সুযোগের ফায়দা লুটছিল। অবশ্য তীর্থযাত্রার মত প্রশংসনীয় আর সম্মানজনক কাজ যারা করে, তাদেরকে সবসময়ই শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয়।
সাধারণত আশেপাশে কোথাও বন্দুকের গুলি ছোড়া হলেই আমার মনিব পালানোর পথ খুঁজতেন আর খাপমুক্ত শমসের দেখলেই ফ্যাকাসে হয়ে আসত তার চেহারা। তবে এ ধরনের কাফেলায় সাধারণত সব যাত্রীর কাছেই অস্ত্র থাকে। তাই মনিবও তেরছাভাবে নিজের পিঠে লম্বা এক কার্বাইন বন্দুক আর কোমরে বাঁকা একখানা তলোয়ার ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। তার ওপরে, তার কোমরবন্ধে ভারি একজোড়া পিস্তলও ঝুলছিল। আর মনিবের দেহের বাকি অংশটুকুও কার্তুজ রাখার বাক্স, বারুদ রাখার পাত্র আর র্যামরডের মত লড়াই করার সরঞ্জামে ঢাকা পড়েছিল। [র্যামরড হল বন্দুকে বারুদ ঠেসে ভরার জন্যে ব্যবহৃত লোহার ডাণ্ডা। – অনুবাদক] পা থেকে মাথা পর্যন্ত আমিও অস্ত্রসজ্জায় সেজেছিলাম। মনিব তার সঙ্গে যা যা নিয়েছিলেন, তার বাইরেও ঢাউস একটা বল্লম চালানোর দায়িত্ব দিয়ে যেন আমাকে বাড়তি ইজ্জত দান করেছিলেন। হাবশি খাদেমের কাছে ছিল অর্ধেক ভাঙা এক তলোয়ার আর অচল এক বন্দুক।
যাত্রার প্রথমদিন ভোরবেলায় জোরে জোরে চিৎকার করে আর তামার নক্কারা (জোড়া ঢোল) বাজিয়ে কাফেলার চাওশরা [যাত্রীদের থাকার জায়গা খোঁজা, যাত্রাপথে সবকিছুর দরদাম নির্ধারণ করা, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের জোগান ঠিক রাখা, নামাজের ওয়াক্ত ঘোষণা করা, ঝগড়া-বিবাদ নিষ্পত্তি করা বা একটানা কতক্ষণ যাত্রা চলবে, তা ঠিক করার মত বিষয়গুলি কাফেলার যেসব কর্মকর্তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। – লেখক] সবার কানে কানে রওনা হওয়ার ঘোষণা পৌঁছে দিচ্ছিল। তাদের নেতৃত্বে ইস্পাহানের শহরতলির উত্তর দিক থেকে আমাদের কাফেলা যাত্রা শুরু করে। অল্প সময়ের মধ্যেই কাফেলার সহযাত্রীদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হতে থাকে। এদের সবার কাছে লড়াই করার হাতিয়ার থাকলেও প্রত্যেককেই শান্তিপ্রিয় আর ভদ্র মানুষ বলেই মনে হচ্ছিল। এর সবকিছুই ছিল আমার কাছে নতুন। তাই মনিবের বিরক্তি সত্ত্বেও অতি উৎসাহে নিজের ঘোড়াটাকে ইচ্ছামত লাফিয়ে-কুদিয়ে চালাচ্ছিলাম আমি। কিছুটা রুক্ষ গলায় তিনি আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন যে, এই অসময়ে ঘোড়সওয়ারীতে নিজের পারদর্শিতা দেখাতে গিয়ে ঘোড়াটাকে ক্লান্ত করে ফেললে সফর শেষ হওয়া পর্যন্ত প্রাণীটা টিকে থাকতে পারবে না। যাদের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম, শীঘ্রই তাদের সবার প্রিয়পাত্র হয়ে উঠি আমি। সারাদিনের যাত্রা শেষে আমি এদের অনেকের ব্যক্তিগত রিশ-তরাশির (ক্ষৌরকর্ম) জরুরৎ মিটিয়েছিলাম। আর মনিবের ক্ষেত্রে এটা বলার অপেক্ষাই রাখে না যে, আমার মাধ্যমে তার আরাম আয়েশের ভাল একটা ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছিল। কারণ যখন তিনি খচ্চরটার উপরে বসে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়তেন, তখন হাত-পায়ের জড়তা দূর করার জন্যে দোকানে থাকতে রপ্ত করা কৌশলে হাত দিয়ে ডলে ডলে তার সারা গা দলাইমলাই করে দিতাম আমি।
কোনো ধরনের বাধাবিপত্তি ছাড়াই আমরা তেহরান পর্যন্ত পৌঁছাই, যেখানে যাত্রীদের সংখ্যা বাড়ানো আর হায়ওয়ানগুলিকে বিশ্রাম দেওয়ার জন্যে দশ দিন কাফেলাবিরতির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সফরের সবচেয়ে বিপজ্জনক অংশটি তখনও শুরু হয়নি। সামনেই পারস্যের শাহের সাথে যুদ্ধরত তুর্কমেনদের একটা দল রাস্তায় যাত্রীদের হয়রানি করছিল। কিছুদিন আগেই তারা একটা কাফেলায় হামলা করে লুটপাটের পর যাত্রীদের সবাইকে বন্দি করে নিয়ে গিয়েছিল। তুর্কমেনদের ব্যাপারে আমার মনিবসহ কাফেলার অন্য অনেকের মনে এই আতঙ্ক থাকায় মেশেদ এর দিকে এগিয়ে যাওয়া হবে কিনা, তার মীমাংসা নিয়ে চলছিল দোলাচল। তবে কনস্টান্টিনোপলে ভেড়ার চামড়ার বিশাল দামের যে হিসাব আমার মনিব পেয়েছিলেন, সেটা এতটাই লোভনীয় ছিল যে, এতকিছুর পরও তিনি লাভের আশায় ভয় না পেয়ে এগিয়ে যাবেন বলে ঠিক করেছিলেন।
আমাদের কাফেলা এসে পৌঁছাবে, সেই প্রত্যাশায় তেহরান আর তার আশেপাশের এলাকায় যাত্রীদের জড়ো করছিলেন এক চাওশ। আমরা পৌঁছানোর সাথে সাথেই তিনি জানালেন, যাত্রীদের একটা বিশাল দল সাথে নিয়ে তিনি আমাদের সাথে যোগ দেওয়ার জন্যে তৈরি হয়ে রয়েছেন। সামনে আমরা যেই ধরনের বিপদের মুখে পড়তে পারি, সেটার কথা বিবেচনা করে অতিরিক্ত এই জনবলকে কৃতজ্ঞতার সাথে গ্রহণ করার পরামর্শও দিলেন তিনি। এই লোক ছিলেন তেহরান আর মেশেদ এর সংযোগ সড়কে খুবই চেনাজানা এক মুখ। আর সাহসের জন্য তার বেশ খ্যাতিও ছিল। অবশ্য এই খ্যাতি তিনি লাভ করেছিলেন রাস্তায় পাওয়া এক মরা তুর্কমেনের লাশের মাথা কেটে নেওয়ার মধ্য দিয়ে। তবে অন্তরে ভয় জাগানোর মত ভয়ঙ্কর ধরনের লেবাস ছিল তার। চওড়া কাঁধের লম্বা এই লোকটার চেহারা ছিল রোদেপোড়া কালচে রঙের। ধারালো থুতনির একেবারে নিচে দাড়ি হিসাবে অল্প কিছু শক্ত লোম চেহারাটা অলঙ্কৃত করে রাখত। তার বুকের ওপরে লোহার তৈরি বর্ম, কাঁধে ছড়িয়ে থাকা কলাহে খোদ (শিরস্ত্রাণ) এর সাথে লাগানো চিকন শেকলের জালিকা, দেহের একপাশে বাঁকা এক শমসের, কোমরবন্ধে ঝুলে থাকা পিস্তল, পিঠে ঝুলে থাকা একটা ঢাল আর হাতে থাকা লম্বা বল্লম দেখলে মনে হত তিনি যখন-তখন বিপদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন। নিজের সাহসিকতা নিয়ে তিনি এত বেশি বড়াই করতেন আর তুর্কমেনদের ব্যাপারে এতটাই তাচ্ছিল্যের সাথে কথা বলতেন যে, আমার মনিব বাকি যাত্রাটুকু তার পাহারাতেই এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। নওরোজ [এই উৎসব পালন করা হয় বসন্তে, যখন সূর্য মেষ রাশিতে গমন করে। আর একে নো’রুজ (নওরোজ) বা নতুন দিন বলা হয়ে থাকে। উৎসবটি মোহামেডানদের মধ্য থেকে আসেনি। আর প্রাচীনকাল থেকেই এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে। – লেখক] উদযাপনের এক সপ্তাহ পর আমাদের কাফেলা রওনা হওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়ে উঠেছিল। শুক্রবারদিন বড় মসজিদে জামাতে নামাজ পড়ার পরে আমরা শাহ আব্দুল আজিমের গ্রামে চলে গেলাম। [সাধারণ্যে শাহ আব্দুল আজিম নামে পরিচিত আবদ আল-আজিম আল-হাসানি ছিলেন শিয়া মুসলমানদের দ্বিতীয় ইমাম হাসান ইবনে আলী’র পঞ্চম প্রজন্মের বংশধর। – অনুবাদক] এরপরের দিন সেখান থেকেই আমাদের কাফেলার যাত্রা আবারও শুরু হল।
রোদেপোড়া, শুকনা আর নিষ্প্রাণ এক এলাকা দিয়ে আমরা ধীরগতিতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। চোখে আরাম আনা বা হৃদয় প্রফুল্ল করার মত তেমন কিছুই আশেপাশে দেখা যাচ্ছিল না। যখনই কোনো গ্রামের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম বা সড়কে কারো সঙ্গে দেখা হচ্ছিল, তখনই আমাদের কাফেলার পরিচালকরা তীক্ষ্ণ স্বরে আল্লাহ আর নবীর নাম জোর গলায় ঘোষণা দিচ্ছিলেন আর তাদের পশুর জিনে চাপানো ঢোলে চামড়ার তৈরি চাবুক দিয়ে বার বার বাড়ি মারছিলেন। আমাদের আলাপ-আলোচনার প্রধান বিষয়ই হয়ে উঠেছিল তুর্কমেনরা। অবশ্য সবাই এই ব্যাপারে একমত ছিলাম যে, প্রতিপক্ষ হিসাবে তারা খুবই নিষ্ঠুর। তারপরও সান্ত্বনার জন্যে নিজেদেরকেই আমরা আশ্বাস দিচ্ছিলাম যে সংখ্যায় আমরা এত বেশি আর এমনভাবে এগিয়ে যাচ্ছি যে কোনো শক্তিই আমাদের সামনে টিকতে পারবে না। একইসঙ্গে আমরা বার বার চিৎকার করে বলছিলাম, ‘আল্লাহ’র নামে বলছি, কার কুকুর ওরা যে আমাদের আক্রমণ করার কথা মাথায় আনে?’ সবাই যার যার সাহস নিয়ে বড়াই করে যাচ্ছিল। আর আমার মনিব তো আছেনই, বিপদের কথা চিন্তা করে তার দাঁতের পাটি ঠক ঠক করে কাঁপলেও আমাদেরকে আক্রমণ করা হলে তিনি নিজে কী কী করবেন, সেসব কথা বড় গলায় বলে যাচ্ছিলেন। তার সেসব কথা শুনলে যে কেউই ভাববে, সারাজীবন তুর্কমেনদের সাথে লড়াই করা আর তাদেরকে খুন করে বেড়ানো ছাড়া কিছুই করেননি তিনি। এদিকে মনিবের বড় বড় কথা শুনে চাওশের মনেও হিংসা হচ্ছিল। কারণ, দলের একমাত্র সাহসী লোক হিসাবে তিনি আর সেভাবে দাম পাচ্ছিলেন না। তাই সবাইকে শুনিয়ে জোরে জোরে সেই চাওশ বলছিলেন, ‘তুর্কমেনদের নিজের চোখে দেখার আগ পর্যন্ত কেউই তাদের ব্যাপারে বলতে পারবে না—আর শুধুমাত্র “যে সিংহও খেয়ে ফেলতে পারে” (এ কথা বলার সময় নিজের গোঁফ পাকিয়ে কানের দিকে টানছিলেন) এমন লোকই তাদের খপ্পর থেকে অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে আসতে পারে। সাদী সত্যি কথাই বলেছেন যে, “যে মরদের হাতে অনেক শক্তি আর গায়ে জোর হাতির মত, যুদ্ধের দিন ভয়ের চোটে, পায়ে বাঁধার দড়ি [প্রাচ্যে ঘোড়া বেঁধে রাখার জন্যে যেই ফাঁস ব্যবহার হয়, ‘পায়ে বাঁধার দড়ি’ দিয়ে সেটাকেই বোঝানো হয়েছে। – লেখক] সে করবে টুকরো টুকরো।”’
তবে ওসমান আগা’র নিরাপত্তা লাভের প্রধান আশা ছিল অন্য জায়গায়। সেই আশাতেই তিনি ভাবছিলেন, আমাদেরকে আক্রমণ করা হলেও তিনি সবার চাইতে ভাল অবস্থায় থাকবেন। আশাটা হল, তিনি ছিলেন ওমরের অনুসারী। [তুর্কমেন আর একই সঙ্গে তুর্কি জাতি আর তাদের বংশধররা সুন্নি ধর্মমতের অনুসারী, যাদের কাছে সবুজ হল পবিত্র একটা রঙ। অন্যদিকে শিয়াদের কাছে রঙটার গুরুত্ব কম। – লেখক]। আর এই ব্যাপারটাই সবাইকে জানান দেওয়ার জন্যে পাগড়ির চারপাশে মসলিনের সবুজ এক টুকরা কাপড় পেঁচিয়ে নিয়েছিলেন, যাতে তাকে একজন আমির অথবা নবীর বংশধর বলে মনে হয়। [ওসমানীয় সাম্রাজ্যে নবীর বংশধররা নিজেদের সামাজিক মর্যাদা প্রকাশের জন্যে সবুজ পাগড়ি পরত। – অনুবাদক] তবে পাঠক হয়ত অনুমান করতে পারবেন, যেই খচ্চরের পিঠে তিনি বসেছিলেন, সেটার তুলনায় ওই বংশের সাথে কোনো অংশেই বেশি আত্মীয়তা তার ছিল না।
একদিন চাওশ গুরুত্বের সাথে খুব গম্ভীর সুরে আমাদেরকে জানালেন যে, আমরা এখন এমন এলাকার মধ্য দিয়ে যাব, তুর্কমেনরা কাফেলার আশায় সচরাচর যেখানে ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করে। এজন্য যাতে চলার সময় সবাই সবার কাছাকাছি থাকি আর হঠাৎ আক্রমণ হলে যেকোনো পরিস্থিতেই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারি, সেজন্যে প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা দিলেন তিনি। বেশ কয়েকদিন ধরে সতর্কতার সাথে এভাবেই পথ চলছিলাম আমরা। তবে প্রথমদিন চাওশের কথা শুনেই আমার মনিব তার বন্দুক, তলোয়ার আর পিস্তলগুলি বেঁধে বোঝা বইতে থাকা একটা খচ্চরের পিঠে রেখে দিলেন। এরপরই জানান দিলেন যে, পেট খারাপের কারণে তাকে বার বার পায়খানায় যেতে হচ্ছে। এই অজুহাতে লড়াইয়ে ঝাপিয়ে পড়ার জন্যে যেসব পরিকল্পনার ব্যাপারে আগে বলেছিলেন, তার সবগুলিই বাতিল করে দিলেন তিনি। আর চেহারার মধ্যে একধরনের দুর্দশা ফুটিয়ে তুলে জোব্বাটা দিয়ে নিজের আপাদমস্তক ঢেকে তসবি জপা শুরু করলেন। থেমে থেমে হঠাৎ করেই তিনি স্তাফেরাল্লাহ বা ‘আল্লাহ, আমাকে ক্ষমা করো’ জিকির করছিলেন। [লেখক এখানে ‘স্তাফেরাল্লাহ’ লিখলেও মূল শব্দটি হল মুসলমানদের মধ্যে বহুল প্রচলিত আরবি পদ ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’। – অনুবাদক] আর এভাবেই তিনি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে ভাগ্যের ওপরে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তখন মনে হচ্ছিল, সুরক্ষার জন্যে সম্পূর্ণভাবে চাওশের ওপরেই নির্ভর করছেন তিনি। অন্যদিকে বিপদের মুখেও কীভাবে অটল থাকেন, সেই ব্যাপারে চাওশ নিজে বহু কেচ্ছা কাহিনী শোনাচ্ছিলেন। বিশেষ করে বহুদিন ধরে তার বাহুতে সযত্নে বেঁধে রাখা অসংখ্য তাবিজ আর কবচ দেখিয়ে বলছিলেন যে, এগুলি সঙ্গে থাকলে তার দিকে ছোড়া তুর্কমেনের তীর সবসময়ই লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে।
দু’দিকে ধারওয়ালা এক তলোয়ার সাথে নিয়ে এই চাওশ আর কাফেলার সবচেয়ে সাহসী আরো দুয়েকজন মানুষ অন্যদেরকে আগাম সতর্ক করার জন্যে মূল দলের সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে আগে আগে পথ চলছিলেন। আর কিছুক্ষণ পর পরই মনে সাহস আনার জন্যে নিজেদের ঘোড়া দ্রুত ছোটাচ্ছিলেন আর এদিক-ওদিকে বল্লম ঘুরিয়ে ফাঁকা বাতাসেই খোঁচাখুঁচি করছিলেন।
আমরা যেই এলাকা নিয়ে ভয়ে ছিলাম, সেটার সীমানা শেষ হয়ে আসছিল। এমন পরিস্থিতিতেই হঠাৎ একদিন কয়েকটা গুলির শব্দ শুনতে পাই। আর তারপরই কানে আসে কর্কশ কণ্ঠের উন্মত্ত কিছু চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ। কাছাকাছি কোথাও বাজপাখি দেখলে ছোট পাখির একটা ঝাঁক যেমনটা করে, সেই মুহূর্তে সেভাবেই পশু-মানুষ নির্বিশেষে আমরা সবাই গাদাগাদি করে সবাই সবার কাছাকাছি আসার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু যখন সত্যি সত্যিই বুঝতে পারলাম যে তুর্কমেনদের একটা দল আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে, সঙ্গে সঙ্গেই তখন পুরা দৃশ্যপট পাল্টে গেল। কেউ কেউ পালিয়ে গেল। আর আমার মনিবের মত যারা ছিলেন, তারা তীব্র ভয়ে শরীরের সব শক্তি হারিয়ে নিজেদের সমর্পণ করে গলা ফাটিয়ে বলছিলেন, ‘ও আল্লাহ!—ও ইমামেরা!—ও নবী মুহাম্মদ; আমরা খতম! আমরা মারা যাচ্ছি! মরে গেলাম সবাই!’ খচ্চর চালকরা তাদের পশুর পিঠে বেঁধে রাখা মালামাল ফেলে নিজেরা সেগুলিতে চড়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। এদিকে প্রতিপক্ষ আগানোর সাথে সাথে যেন আমাদের ওপর তীরের বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। সেই বৃষ্টিতে ধরাশায়ী হয়েই আমরা তাদের সহজ শিকারে পরিণত হলাম। আর সেই চাওশ, যে কিনা এমন ধরনের বহু লড়াইয়ে এর আগেও অংশ নিয়েছে, সে শত্রুদের দেখার সাথে সাথেই পিঠটান দিয়েছিল। এরপর থেকে আমরা আর কখনোই তাকে দেখিনি বা তার ব্যাপারে শুনিনি। কিছুক্ষণ পরই হানাদাররা আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা কাফেলার যাত্রীদের মালপত্রের দিকে মনোযোগ দেওয়া শুরু করল।
মনিব নিজের পালা আসার অপেক্ষা করার জন্যে দেহটা গুটিয়ে গাঁটবন্দি দুটি বোঝার মধ্যে শুয়ে পড়েছিলেন। এমন সময় ভয়ানক চেহারা আর বিশাল দেহের এক তুর্কমেন মালপত্র ভেবে নিজের কাঁধের ওপর ফেলে আমার মনিবকে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল। তখনই (ঘুণপোকার মত করে) তিনি হঠাৎ নিজেকে সম্পূর্ণ মেলে ধরলেন আর অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে অনুনয় বিনয় করে নিজের সমস্ত আতঙ্ক প্রকাশ করতে লাগলেন। আবার ওমরের নাম ধরে প্রার্থনা করে আর আলীকে অভিশাপ দিয়ে ওই তুর্কমেনের মন গলানোর চেষ্টাও চালালেন তিনি। কিন্তু কিছুতেই কোনো লাভ হল না। বর্বর সেই লোক ছিল একেবারেই নির্দয়। শুধুমাত্র রঙের ব্যাপারটা চিন্তা করে আমার মনিবকে তার পাগড়িটা ফেরত দেওয়া হল। এছাড়া তাকে মোটামুটি উলঙ্গই করে ফেলা হল বলা যায়। শুধুমাত্র পাতলা একটা জামা আর অন্তর্বাস ছাড়া সব কাপড় খুলে নিয়ে আমার মনিবের সামনেই সেই তুর্কমেন তার আরামদায়ক জোব্বা আর শালওয়ার চটপট পরে ফেলল। আমার জামাকাপড় এতই সস্তা ছিল যে, সেগুলি কেড়ে নেওয়ার চেষ্টাও কেউ করেনি। তাই সেগুলি পরে থাকার অনুমতি পেয়েছিলাম আমি। একইসঙ্গে ক্ষুরের বাক্সটাও রাখতে পেরেছিলাম নিজের কাছে। তখন আমার কাছে বিষয়টা মোটেও ছোটখাটো কোনো খুশির কারণ ছিল না।
লুটপাট শেষে তুর্কমেনরা নিজেদের মধ্যে বন্দিদের ভাগাভাগি করে নিল। আমাদের চোখ বেঁধে প্রত্যেককেই একেকজন ঘোড়সওয়ারের পেছনে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। এভাবে সারাদিন পথচলার পরে রাতের বেলায় ছোট্ট একটা শুনশান উপত্যকায় বিশ্রাম নিয়েছিলাম আমরা। পরদিন চোখের পট্টি খুলে দেওয়ার পরে দেখলাম, আমরা এমন এক রাস্তায় এসে পড়েছি, যেই রাস্তা শুধু তুর্কমেনরাই চেনে।
জনশূন্য, প্রত্যন্ত আর পাহাড়ি এলাকার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে অবশেষে বিশাল এক সমভূমি চোখে পড়ল। সেটা এতই বিস্তীর্ণ ছিল যে, দেখে মনে হল এটাই পৃথিবীর শেষ সীমানা। পুরা জায়গাটাই কালো রঙের সব তাঁবুতে ঢাকা পড়েছে। মধ্যে মধ্যে শুধু আমাদের প্রতিপক্ষের গৃহপালিত পশুপাখির ঝাঁক ঘুরে বেড়াচ্ছে।
(চলবে)