এপ্রিল ৭, ২০১৪

আমি বেশিরভাগ সময়েই বেশ কিছু ইমপালসিভ (রিড—বুদ্ধিহীন) কাজ করি, এবং পরে ভাবি এত গাধা কেমনে হইলাম আমি।

গতকালকে লাঞ্চে বন্ড স্ট্রিটের একটা ক্যাফেতে বইসা বার্গার আর মিষ্টি আলু ভাজা খাইতেছি আর ক্যান্ডি ক্রাশ খেলতেছি, সামনের টেবিলের পঁচিশ-ছাব্বিশ মতন একটা হিপ্পি মাইয়া আমারে তার রকি-রোড-সানডে’র গ্লাস আগায়া দিয়া বল্লেন, “খাবা, আমার সাথে?”


নাদিয়া ইসলাম


একটু অবাক হয়া তাকাইলাম আমি উনার দিকে। আমার ন্যাতায়া যাওয়া আলুর দিকে ইঙ্গিত কইরা বললাম, “না, না, আমি লাঞ্চ করতেছি। এখন মিষ্টি খাব না।”

রকি রোড সানডে
আমি (নাদিয়া ইসলাম)

উনি তারপরেও মিনিট পাঁচেক “প্লিজ খাও, প্লিজ খাও” বইলা ঝুলাঝুলি করলেন, আর আমি আদতে যেহেতু একজন ‘পুশ-ওভার’, অর্থাৎ অন্যের ঠেলাঠেলিতে সহজে কনভিন্স হইয়া যাই এবং “না” বলতে পারি না, তাই আমারে শেষ পর্যন্ত নিজের গ্লাস প্লেট নিজের টেবিলে রাইখা উনার টেবিলে সানডে খাওয়ার জন্য জয়েন করতে হইল।

উনি ওয়েট্রেসরে ডাইকা আরেকটা ডেসার্ট চামচ আনাইলেন। আমি মার্শমেলো আর বাদাম আর ফাজ ব্রাউনি আর আইসক্রিম আর বাটারস্কচ সসের ঘ্যাঁট খাইতে খাইতে উনারে দেখতে থাকলাম।

হাড় জিরজিরা শুকনা, স্টাডেড কালো বাইকার জ্যাকেট, কালো টি-শার্টের হাতার নিচ দিয়া কালো আর ছাই রঙের গোলাপ আর কাঁটাতারের উল্কি দেখা যায়। কাঁটাতারের পাশেই ক্ষীণ কোমর ও বিশাল বক্ষের মাথায় কালো কাপড়ের ফেট্টি বান্ধা উল্কি—মহিলা উনার বড় বড় হতাশ চোখে আমার দিকে তাকায়া আছেন।

বন্ড স্ট্রিটের গথ মেয়ে ও রকি রোড সানডে, অলঙ্করণ: নাদিয়া ইসলাম

হাড় জিরজিরা শুকনা, স্টাডেড কালো বাইকার জ্যাকেট, কালো টি-শার্টের নিচে দিয়া উনার কালো আর ছাই রঙের গোলাপ আর কাঁটাতারের উল্কি দেখা যায়। কাঁটাতারের পাশেই ক্ষীণ কোমর ও বিশাল বক্ষের মাথায় কালো কাপড়ের ফেট্টি বান্ধা মহিলা উনার বড় বড় হতাশ চোখে আমার দিকে তাকায়া আছেন। আমি চোখ থাইকে চোখ সরায়ে উনার কথায় মনোযোগ দিলাম। দেড় ঘণ্টা আলাপ ও ধূম্রপানের পর আমাদের ফোন নাম্বার বিনিময় হইল। আমার বাম গালে চুমা দিয়া যখন উনি বিদায় জানাইয়া চইলা যাইতেছেন, তখন মনে হইল, এই মহিলা নিশ্চই লেসবিয়ান।

ফোন নাম্বার দেওয়াটা বিশাল বোকামি হইছে। এবং সেই বোকামি কত প্রকার ও কী কী তার ঘণ্টা ছয় পরেই টের পাইলাম—ফোনে এবং ‌`ওয়াস’সাপে সাতান্নটা (তার মধ্যে একটা ভিডিও) মেসেজ রিসিভ কইরা। নিজেরে বোকামির জন্য নিজেরে গালি দিব কিনা ভাবতে ভাবতে ফোন-টোন তাড়াতাড়ি বন্ধ কইরা ঘুম দিলাম আমি।


রকি রোড সানডে’র (Rocky Road Sundae) দুই নাম্বার রেসিপি, এক নাম্বার রেসিপি পরে কোনো এক সময়ে দেয়া যাবে।

উপকরণ
মার্শমেলো বা ভ্যানিলা আইসক্রিম, দুই স্কুপ
চকলেট ক্রাঞ্চ বা চকোলেট আইসক্রিম, এক স্কুপ
চকলেট ব্রাউনি, এক স্লাইস
বাটারস্কচ সস
চকলেট সস
ভাজা লবণমিশানো বাদাম ১ টেবিল চামচ (আধা ভাঙা)
মার্শমেলো ১ টেবিল চামচ
‘গ্লাসে’ চেরি অর্থাৎ সুগার সিরাপে ভিজায়ে ক্যান্ডি বানানো মারাশিনো চেরি ৩/৪ টা

রকি রোড সানডে আইসক্রিম, ছবি: ইন্টারনেট

প্রণালী
সানডে ডিশের উপর গরম (বা হালকা গরম) ব্রাউনির উপরে ঠাণ্ডা চকলেট আইসক্রিম, তার উপরে গরম চকলেট সস, তার উপরে বাদাম, তারপরে মার্শমেলো বা ভ্যানিলা আইসক্রিম, আইসক্রিমের উপরে গরম বাটারস্কচ সস এবং সবশেষে মার্শমেলো, আরো বাদাম, চেরি ইত্যাদি দিয়া একটা হ-য-ব-র-ল বানাইলেই তৈরি হইল ‘রকি রোড সানডে’!


আজকে কোর্টে যাইতেছি সকাল বেলায়। হঠাৎ পিছন থাইকে কে যেন আমার ঘাড়ে হাত দিয়া ডাক দিলেন, “এ্যাই, এ্যাই!”

আমি আমার ইস্ত্রিকরা গ্রে শার্টেরে ক্যাফে নিরোর নীল কাপ থাইকে ঝমকায়ে বাইর হওয়া মাকিয়াটোর হাত থাইকা বাঁচাইতে বাঁচাইতে চমকাইতে চমকাইতে পিছনে তাকাইলাম। অত্যন্ত রাগতঃ স্বরে কইলাম, “এ্যাই এ্যাই মানে কী? আমারে কি তোমার ইয়ার দোস্ত মনে হয়?” কথাটা বইলেই বুঝলাম, আবার বিশাল বড় ভুল হইছে। এরেই কয়, খাল কাইটা কুমির আনা। শুধু যে আমি কুমির আনছি তা না, কুমিরের গায়ে লাফ দিয়া পড়ছি দড়িদড়াসমেত।

ছেলেটা অসম্ভব সুন্দর দেখতে। ডেভিডের মূর্তি বা ক্যানভাসে তেলরঙে আঁকা দুষ্মন্তের মত শার্প ফিচার। মাথায় কোঁকড়া বাদামি রঙের চুল। সাদা ছেলেরা যত সুন্দর হয়, তাদের হাসি হয় তত বদ-মার্কা। আমারে অবাক কইরা সারা শরীর ও চোখ মুখ কাপায়া ছেলেটা নিধুবাবুর টপ্পার মত হাইসা উঠলেন, আর আমি মনে মনে উপমা খুঁজতে থাকলাম। কার হাসির সবাই খুব প্রশংসা করেন? বাচ্চাদের? ধুর, বাচ্চাদের হাগামুতা থিকা শুরু কইরা সবকিছু মহিমান্বিত করার আমাদের বাজে স্বভাব আছে। বাচ্চাদের হাসি তখনই সুন্দর, যখন বাচ্চা ইটসেলফ সুন্দর দেখতে। মোনালিসা? না, ধুর। হাসির মধ্যে রহস্য-ফহস্য আবার কী?

ছেলেটা আমার গোল গোল চশমার দিকে ইঙ্গিত কইরা কইলেন, “তোমার চশমাটা খুব সুন্দর। তোমার চুলের সাথে খুব ভাল মানাইছে। খুব সুন্দর কনট্রাস্ট হইছে। তুমি আর্টিস্ট?”

আমি প্রশংসায় গইলা যাইতে যাইতে চশমা বাড়ায়ে দিলাম উনার দিকে, “নিবেন?”

উনি হাত বাড়ায়ে চশমা নিলেন।

—সিরিয়াসলি?

“হ্যাঁ, নেন। আপনারেও তো সুন্দর লাগতেছে। হ্যারি পটারের মত লাগতেছে।”

ছেলেটা আমার হাই-পাওয়ারড চশমা পইরা উলটা দিকে হাঁটা দিলেন। আমি কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে পানিতে ভিজা ঘোলা ঘোলা রাস্তা দেখতে দেখতে ওল্ড বেইলিতে গিয়া পৌঁছাইলাম। আজকে কিছুই লেখা হবে না। কোর্টে যা যা হবে, মুখস্থ করতে হবে সবই। নিজেরে সান্ত্বনা দিলাম, যাক, কলম না আইনা এমন কিছু ভুল করি নাই আমি।


এপ্রিল ৯, ২০১৪

সকাল দশটায় ট্রায়াল আজকে। হিয়ারিং শেষ, আজকে সেন্টেনসিং হবে। প্রসিকিউশানের প্রধান উইটনেসরে আধা ঘণ্টা যাবৎ প্রশ্ন করছেন ডিফেন্স ব্যারিস্টার। ঠিক কয়টার সময় উইটনেস ক্রাইম সিনে ছিলেন, কী কী দেখছেন এই নিয়া ঘুরায়ে প্যাঁচায়ে মোটামুটি সাড়ে তিনশ’ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার পরে ব্যারিস্টার সাহেব স্মিত হাইসা আশ্চর্য শান্ত গলায় উনারে বললেন, “যেদিন ঘটনা ঘটেছে সেদিন আপনি কাজেই যাননি। আমার কাছে আপনার কাজের রোটা আছে। সেদিন আপনি সিক-কল করেছেন, এবং সকাল এগারটা দশে আপনি আপনার জিপি (জেনারেল প্র্যাকটিশনার) অফিসে ছিলেন।” ব্যারিস্টার সাহেব তার ফাইল থিকা তিনটা কাগজ বাইর কইরা কোর্ট আশারের হাতে ধরায়ে দিলেন জাজরে দেওয়ার জন্যে, “আই হ্যাভ নো ফারদার কোয়েশ্চেন।”

তেমন কোনো ইন্টেরেস্টিং কেইস ছিল না এইটা। হরিনারায়ণ হারশ প্যাটেল নামক এই ভারতীয় ভদ্রলোক ভিক্টোরিয়ার ম্যারিয়ট হোটেলরে স্যু’ করছিলেন। উনি ছিলেন হোটেলের স্যু শেফ। হোটেলের বিরুদ্ধে উনার অভিযোগ, উনারে ঠিকমত পয়সা দেয়া হয় নাই, উনি ইংরেজি বলতে পারেন না বইলা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে উনারে রেইসিস্ট অপমান করা হইছে, এবং ক্রিসমাস, অর্থাৎ ব্যস্ত সময় শেষ হওয়ার পরে কোনো কারণ ছাড়াই উনারে বাইর কইরা দেওয়া হইছে।

হোটেলও অবশ্য কম ধড়িবাজ না। উনারা উলটা প্যাটেল সাহেবের নামে এ বি এইচ (অ্যাকচুয়াল বডিলি হার্ম) এর মামলা ঠুঁইকা দিছে। উনাদের বক্তব্য, প্যাটেল ছিলেন প্রবেশান পিরিয়ডে। এই সময়ে উনি কোনো কাজই ঠিকমত করেন নাই। যখন উনারে চইলা যাইতে বলা হইছে, তখন উনি ছুরি নিয়া হেড শেফরে তাড়া করছেন। উনার গায়ে চপিং বোর্ড ছুইড়া মারছেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমি টিউবে উঠতে উঠতে ব্যারিস্টারের কথা ভাবতে ভাবতে নিজে নিজেই হাসলাম। আমার সামনের ভুড়িওয়ালা ভদ্রলোক একটা ভুরু উঁচা কইরা আমার দিকে তাকাইলেন। 

রকি রোড সানডে
সকালের সেন্ট্রাল লাইন, ছবি: ইন্টারনেট

সকালবেলা লন্ডনের টিউব গম্ভীর আর বিরক্ত মানুষে ভর্তি থাকে। উনারা মুখ গম্ভীর কইরা ফ্রি পত্রিকা পড়েন, গম্ভীর ভঙ্গীতে হেড-ফোনে গান শুনতে শুনতে ততধিক গম্ভীর ভঙ্গীতে পা নাচান, গম্ভীর চোখে আই-প্যাড, আই-ফোন এবং কিন্ডেলে গেইম খেলেন, ভিডিও দেখেন ও বই পড়েন। কেউ কেউ গম্ভীর ভঙ্গীতে উলের কাঁটা নিয়া বাচ্চাদের নীল সোয়েটার বুনতে থাকেন, এবং সেইসময় কোনো অগম্ভীর বাচ্চা হঠাৎ কাইন্দা ফেললে তার দিকে গম্ভীর দৃষ্টিপাত করেন।

সকালের টিউব বাচ্চাদের জন্য না। সকালের টিউবে কথা হয় না কোনো, খালি লাইনের উপ্রে টিউবের চাকার ঘষা খাওয়ার কনটিনিউয়াস হিস্‌ হিস্‌ শব্দ, আর স্টেশানে স্টেশানে ভারি গলার মহিলার কম্পিউটারাইজড অ্যানাউন্সমেন্ট শোনা যায় কয়েক মিনিট পর পর।

আমার মানুষ দেখতে ভাল লাগে বরাবর। আমিও কানে হেড-ফোন লাগায়ে চোখের সামনে একটা কিন্ডেল ধইরা রাখি সবার মত। আমার মনোযোগ অবশ্য থাকে আশেপাশের মানুষের দিকে। কোনো মহিলার হাতে অরিজিনাল লুই ভিতনের ব্যাগ, কিন্তু ব্যাগ থিকা বাইর করলেন জব-সিকার অ্যালাউয়েন্সের কাগজ। কেউ আশেপাশের সবাইরে দেইখা নিয়া ফট কইরা নাকের ময়লা টাইনা বাইর কইরা তার দিকে তাকায়ে থাকলেন অনেকক্ষণ। কেউ এক আঙুলের রঙ উইঠা যাওয়া নখটা ঢাইকা রাখতেছেন অন্য হাত দিয়া। কেউ পাশের মানুষের সাথে যাতে ঘষা না লাগে সেইজন্য সন্তর্পণে বসছেন নিজের হাঁটু ধইরা।

কত রকমের আজব মানুষ যে দুনিয়ায়! তবে, সকাল বেলার টিউবে উনারা সবাই গম্ভীর এবং অসুখী। এবং বিরক্ত এবং যারপরনাই সভ্য। এই মানুষগুলাই রাতের টিউবে অবশ্য অন্যরকম হয়ে যাবেন। তখন উনারা চাকার আওয়াজের সাথে পাল্লা দিয়া চিল্লায়ে কথা বলবেন, আশে পাশের ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা দেইখা জ্যাকেটের পকেটে লুকায়ে রাখা ভারতের উচ্ছ্বসিত সবুজ রঙের চ্যাপ্টা মদের বোতল বাইর কইরা নিয়া আসবেন, মহিলারা চলন্ত ট্রেইনেই তাদের চোখে নিখুঁত সরু নীলরঙা আই লাইনার লাগাবেন, কেউ মাতাল হয়া হাসতে হাসতে বা হাসতে হাসতে মাতাল হয়া একে অন্যের গায়ে গড়ায়ে পড়তে থাকবেন একটু পর পর।

রকি রোড সানডে
রাতের টিউব – নো প্যান্টস ডে অ্যাট ওয়ার্ক ২০১২, ছবি: ইন্টারনেট

মাইল এন্ড স্টেশান থিকা এক বুড়া ভদ্রমহিলা উঠলেন সেন্ট্রাল লাইনে। আমার পাশের মহিলা বইসা ছিলেন প্রায়োরিটি সিটে। বুড়া মহিলারে দেইখা উনি উইঠা দাঁড়াইলেন। বুড়া ভদ্রমহিলা আমার পাশে আইসা বসলেন। উনি বসার সাথে সাথেই কীসের যেন হালকা একটা গন্ধ পাইলাম আমি। আমার গন্ধের সেন্স খুব খারাপ, তাই পাত্তা দিলাম না বিশেষ। তবে আমার সামনে দাঁড়ানো মহিলারে দেখলাম নাক কুঁচকায়ে আরেক দিকে তাকায় আছেন। বুড়া মহিলাও মনে হয় সেইটা আঁচ করতে পারছেন। সামনের মহিলারে ডাইকা বললেন, উনি দুঃখিত, আন্ডারগ্রাউন্ডে কাজ করেন, কবুতর তাড়ান, সারা রাত কাজ করছেন, তাই এমন গন্ধ। আমি অভদ্রলোকের মত কান খাড়া কইরা শুনতে থাকলাম। কবুতর তাড়ান, মানে কী?

মহিলা গল্প কইতে থাকলেন। সামনের মহিলা নিরাসক্ত ভঙ্গিতে দাঁড়ায়ে দাঁড়ায়ে দাঁত দিয়া নখ খুঁটতে খুঁটতে মেট্রো পড়তেছেন এবং মাঝেমধ্যে বুড়ির দিকে তাকায়ে মাথা নাড়তেছেন।

“১৯৬৪ সালে আমি লন্ডন আসছি। ইউক্রেইন মানে তখনকার সোভিয়েট ইউনিয়ন থিকা। আমার দাদার দাদা ছিলেন পোলিশ। উনার আব্বা কোজাক বিদ্রোহের সময় আমার দেড় মাসের দাদার দাদারে নিয়া লেফট ব্যাঙ্কে চইলা আসেন। তখন প্রায় পুরা ইউক্রেনই রাশা মানে সোভিয়েট ইউনিয়নের আন্ডারে ছিল। রাইট ব্যাঙ্করে তো আলাদা কইরা ফেলা হইছিল। পরে আবার জোড়াও লাগে। ঠিক বলতেছি কিনা শিওর না, মনে হয় ঠিকই বলছি, বুড়া হইছি তো, সব কিছু মনে থাকে না ঠিকমত।” এই বেলা আমার দিকে তাকাইলেন বুড়ি। “তোমরা পড়ো না এইগুলা স্কুলে? ঠিক বলছি?”

আমি মাথা নাড়লাম, “না, এইগুলা জানি না। আমাদের এইসব পড়ায় নাই। আমাদের দেশের হিস্ট্রি পড়ছি। আর ওয়ার্ল্ড ওয়ার পড়ছি। কোল্ড ওয়ার জানি অল্প একটু। ও, হ্যাঁ, আর ভিয়েতনাম ওয়ার। আর কিছু না।”

মহিলা হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন।

তো যাই হোক, আমার আব্বা ছিলেন জুইশ। তারে মাইরে ফেলছিল হিটলারের লোকেরা। কী খারাপ একটা লোক, চিন্তা করতে পারো?

জ্বি জ্বি।

জুইশদের দোষ কী? এই যে এখন মানুষ ইন্ডিয়ানদের দেখতে পারে না, তুমি তো ইন্ডিয়ান, নাকি? তো ইন্ডিয়ানদের দোষ কই বলো?

জ্বি না, আমি ইন্ডিয়ান না, আমি বাংলাদেশ থিকা আসছি।

সেইটা কোথায়? মরিশাসে? তো যাই হোক, আমার আব্বা আম্মা পোল্যান্ডে বিয়ে করছিলেন। আমার একটা বড় ভাইও ছিল। সে মারা গেছে অনেক আগে। ইনফেকশান হইছিল পায়ে। তারপরে আরেকটা বাচ্চা মারা গেল আমার মায়ের। পেটের মধ্যেই। এখন কত রকমের চিকিৎসা, তাই না, তখন তো এইসব ছিল না! সেই নিয়া আমার মায়ের সারাজীবন দুঃখ ছিল। সবগুলা ছেলে মইরা গেল।

পেটেরটা ছেলে, এইটা জানলেন ক্যামনে উনি?

আমি তো জানি না, মা’রা বুঝে এইসব, বুঝছো? তোমার বাচ্চা হইলে তুমিও বুঝবা। বাচ্চা আছে নাকি তোমার? তোমরা ইন্ডিয়ানরা তো আগে আগে বিয়া করো!

আমি ইন্ডিয়ান না তো।

আচ্ছা, আচ্ছা। তো আমি আসলাম এই লন্ডনে। বিয়া করছিলাম একটা। টিকে নাই। আমার স্বামী ড্রাগ এডিক্ট ছিল। কেমিস্টের চাকরি করত চেরক্যাসিতে। চেরক্যাসি চিনো?

আমি ডানে বামে মাথা নাড়লাম।

যুদ্ধের পর পর বানাইছিল। এখন তো বিশাল বড় কোম্পানি। নাইট্রোজেন সার বানায় ওরা।

আমি মাথা কাৎ কইরা শুনলাম টিউবের কম্পিউটারাইজড মহিলা-গলা জানাইলেন সামনের স্টপ সেইন্ট পল। বুড়িরে বললাম, “আমার তো নাইমে যাইতে হবে। আপনার গল্পটা তো শোনা হইল না। ওই যে আন্ডারগ্রাউন্ডে কবুতর তাড়ানোর গল্পটা!”

মহিলা মাছি (অথবা কবুতর) তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নাচাইয়া কইলেন, “হবে, হবে নে, কোনো এক সময়!”

আমি আবার ডিফেন্স ব্যারিস্টারের কথা ভাবতে ভাবতে হাসতে হাসতে টিউব থিকা নামলাম। সামনে দাঁড়ানো মহিলা আমার দিকে ভুরু কুঁচকায়ে তাকাইলেন।

(রকি রোড সানডে ২)