মায়াকানন
আমাকে একবার ভাল করে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বলল, “তুমি এত ছোট স্কার্ট কেন পরেছ? একটু বড় বড় জামা পরে না—সালোয়ার কামিজ—ওইসব নেই তোমার?”

আমাকে একবার ভাল করে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বলল, “তুমি এত ছোট স্কার্ট কেন পরেছ? একটু বড় বড় জামা পরে না—সালোয়ার কামিজ—ওইসব নেই তোমার?”
ছোটবেলা থেকেই আমার একটি ভাল গুণ ছিল। পাড়ার বৃদ্ধরা আসতেন আমাদের বাসায় নিরাপদে হাত-পায়ের নখ কাটাতে। এই কাজটা আমি খুব মনোযোগ দিয়ে করতাম আর ভাল লাগত যখন অবাক হয়ে বড়রা বলত, এত্তটুকু মেয়ে এত সুন্দর করে নখ কাটতে পারে!
আমার বাবা মজা করে বলতেন আমি বড় হলে আমাকে একটা ‘কবলার হাউজ’ খুলে দিবেন। তখন আমি একটু ক্যানকেনে স্বরে ঘ্যান ঘ্যান করে নাকি কান্না কাঁদতাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘ্যান ঘ্যানানি থেমে যেত, যখন বাবা আমাকে টাকা দিয়ে হাবুর দোকান থেকে আমার জন্য একটা চকবার আইসক্রিম আর বাবার জন্য এক প্যাকেট বেনসন আনতে বলতেন। আইসক্রিমের প্রতি আগ্রহ আমার কবলার হাউজ সংক্রান্ত অপমান ভুলিয়ে দিত।
প্রথম দিকে ঘরের মানুষদের নখ কাটা থেকে শুরু। তখন আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। যেই এলাকায় আমরা থাকতাম সেটা ছিল ঘটি এরিয়া। মানে সবাই ইন্ডিয়ান আর মানুষ তাদের ঘটি সম্বোধন করে। কেন তা আমি জানি না। বাসাবো, মায়াকানন এলাকায় যারা বাড়িওয়ালা আর ভাড়াটিয়া তাদের ৮০% ছিল এই ঘটি। মানে তাদের পূর্বপুরুষরা ইন্ডিয়ান, নয়ত দেশভাগের সময় চলে আসা উদ্বাস্তু। আমার মাকে তার দেশের জন্য বেলায় বেলায় দীর্ঘশ্বাস ফেলতে দেখতাম। আর মায়ের মত আরো যারা মায়ের স্বদেশী পাড়াত বান্ধবী মহিলারা সকাল বিকাল আড্ডা দিতে আসতেন তারাও সবাই মিলে মুদুস্বরে আর্তনাদ করতেন। আমি তাদের অসুখীতার কারণ খুঁজে পেতাম না।
নওয়াজ ফারহিন অন্তরা
আমি মায়ের নখ কেটে দিচ্ছি দেখলে সেই আন্টিরা চোখগুলো টেপা টেপা করে বলতেন, বাহ ভাল তো, আমাকেও কেটে দাও তো অন্তু মা। এত সুন্দর আর্ট করে নখ কাটতে পারো এই বয়সে, আসলেই দারুণ।
আমার মা-আন্টিদের কথায় মনে হত অনেক বেশি আপ্লুত হয়ে যেতেন। তখন মা বলতেন, আমি আমার ছেলে-মেয়েকে বাইরে বাইরে অন্য ছেলে-মেয়েদের সাথে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে খেলতে দেই না। ওরা আমার কথা শোনে। বাইরে যায় না, সময় নষ্ট করে না। আমি অন্তরাকে আর্ট শেখাচ্ছি, সেইখান থেকেই ওর মধ্যে একটা শৈল্পিক ধারণা চলে আসছে। তাই নখটা এত সুন্দর কাটতে পারে।
মায়ের এই কথাগুলো আমার একটু কেমন যেন লাগত। আমার মাকে দেখেছি ছোটবেলা থেকেই একটু অহঙ্কারী। আমার নানা বেশ বড়লোক ছিলেন। আন্টিদের ছেলে-মেয়েরা পাড়ার রাস্তায় খেলে সকাল বিকাল দুপুর যখন তখন। সেই কারণেই আন্টিদের জন্য মা’র ওমন ঠ্যাসমার্কা উক্তি—তা আমি যখন বুঝি আন্টিরাও বুঝতেন। তখন আমি আন্টিদের যে মন খারাপ হত সেটা বুঝতাম বলে পরিস্থিতি গুমোট হওয়ার আগেই বলতাম, “আন্টি দেন আপনার হাতটা, আমি সুন্দর করে নখ কেটে দেই। পরে আপনি মেহেদী দিয়েন, দেখবেন হাতটা অনেক ভাল লাগবে দেখতে!”
আমি একটু সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার চেষ্টা করতাম, তাই সাথে সাথে এটাও বলতাম যে, “দেখেন আন্টি আম্মুর হাতটা, আম্মু তো এমনিতেই ফর্সা তার উপর নখ কাটার পর হাতে মেহেদী দিয়েছে, কত সুন্দর লাগছে হাতটা!”
আন্টিরা বেশ হু হু বলতেন। আর আম্মু খুশী হতেন কিনা বুঝতাম না। কেমন গম্ভীর ভাব নিয়ে থাকতেন। আম্মু যে সবার মত গৃহিনী না, নিজের বেশ ভাল বিজনেস আছে, বুটিকসের বিজনেস ভাল চলছে এবং তিনি সবার মত কিপটা না, হাত খুলে খরচ করেন তা আম্মুর কথাবার্তায় স্পষ্ট ছিল। প্রায়ই পাড়ার মহিলাদের নিয়ে নিজের টাকায় চাং পাই রেস্টুরেন্টে, রমনা চাইনিজে যেতেন খাওয়া-দাওয়া করতে। আর খাওয়ার পর এই সংবাদটাও দিতেন যে, আমি তো আমাদের বাড়িওয়ালা বাচ্চু ভাইয়ের ওই বেকারির পাশের ফাঁকা রুম দুইটা ভাড়া নিলাম। আমার বুটিকসের মেয়েগুলির জন্য একটা বড়সরো কারখানা দরকার ছিল। এখন ওখানেই ব্লক-বাটিক কাটিং এর কাজটা করাতে পারব। আর ওদের থাকারও একটা জায়গা হয়ে যাবে। কী বলেন ভাবি, ভাল হল না?
আন্টিরা একটু ঠোঁট ফুলিয়ে অবাক হয়ে “বেশ” “বেশ” বলতেন। এটা আম্মুকে খুব তৃপ্তি দিত। আর আমার বাবাকে মানসিকভাবে কী দিত তা না জানলেও, মা যে বাবাকে নতুন একটা কমপ্লিট স্যুট অথবা দাদাবাড়ির লোকজনদের জন্য পোশাক কিনে পাঠাতেন সেটা দেখতে পেতাম।
মা যে খুব অহঙ্কারী ছিলেন তা না, আম্মু বেশ সমাজসেবাও করে বেড়াতেন। ফ্রিল্যান্সার সমাজসেবিকা টাইপের ছিলেন। নিজের একটা এনজিও করেছিলেন। পরে নিজের পকেটের টাকা শেষ হওয়ায় ব্যানারহীন ভাবে কাজ করতেন। মা বাইরের সব কাজ করতেন, বাজারটাও মা করতেন। তো বাসাবো বাজারে প্রায়ই দেখতেন একজন সত্তুর-উর্ধ্ব বৃদ্ধা খুব আস্তে আস্তে হেঁটে হেঁটে বাজার করতেন। সব সময় একাই থাকতেন। এরপর মা যখন ফিরতেন দেখতেন ওই বৃদ্ধা আমাদের কয়েক গলি পরেই থাকেন।
একদিন মা বাজারে উনাকে দেখে কাছে গিয়ে বললেন, “খালাম্মা আপনি কেন এই বয়সে বাজারে আসেন? আমাকে দিন ব্যাগটা। আমার বাসা আপনার বাসার কাছেই। আমি নামিয়ে দিচ্ছি।” সেদিন নানুমনি মাকে তার বাসায় নিয়ে গেলেন। চার কামরার সেই বাসায় উনি একাই থাকতেন। কিন্তু ঘর দেখে ফ্যামিলি বাসাই মনে হয়। সাজানো গোছানো, ঘরভরা আসবাবপত্র সবই আছে। নানু সেদিন মাকে তার জীবনের গল্প বললেন।
উনি ছিলেন জামালপুর মহিলা কলেজের সহকারী প্রধান শিক্ষিকা এবং তার ডিস্ট্রিক্টের মহিলা খেলোয়াড় দলের কন্ট্রোলার। হাসব্যান্ড মারা গিয়েছেন ১০ বছর হয়েছে। উনি তার হাসব্যান্ডের দ্বিতীয় বউ হওয়ায় ৫জন সৎ ছেলে-মেয়ে ছাড়াও অনেক সম্পত্তি রেখে গিয়েছিলেন সেই নানা। কিন্তু মানুষের চাপে সব সম্পত্তি তাদের নামে করে দিয়ে নিজের পেনশনের টাকা ব্যাংকে রেখে এখন ঢাকায় থাকেন ব্যাংকের ইন্টারেস্টের টাকা দিয়ে। সেই কারণে টাকাপয়সাহীনতার চাপ না থাকলেও একাকীত্ব নানুকে খুব কষ্ট দেয়। নানুর একটা মাত্র ছেলে আছে নিজের ঘরের। ওই নানুমনির ছেলে, মামা ১২ বছর যাবত সুইজারল্যান্ডে থাকেন, দেশে আসেন না। সম্পত্তির ভাগও চান না, মাকেও দেখতে আসেন না। তবে ফোনে নিয়মিত যোগাযোগ করেন।
এই দশ বছর নানুমণি একাই থাকেন, একাই বাজার করেন, রান্না করেন। শুধু ঘরের কাজের জন্য একজন বুয়া রেখেছেন। মাঝে মাঝে সৎ মেয়ে এসে দেখে যান। সৎ মেয়ের ছেলেদের নানু খুব ভালবাসতেন। তাদের পড়ালেখা করাতেন ইংলিশ মিডিয়ামে নিজের টাকায়। এই জন্যই হয়ত সেই সৎ মেয়ে মাসে কয়েকবার রান্না করে আনতেন নানুর জন্য। আর সাথে তার ছেলেদের প্রতি মাসের পড়ার খরচের টাকাটাও নিয়ে যেতেন নানুর কাছ থেকে।
সেইদিনের পর থেকে নানুমণি আমাদের বাসায় দুই বেলা আসতেন আর চার বেলা আমাদের বাসাতেই থাকতেন। নানুর সেই সৎ মেয়ে উনার বাসায় গিয়ে উনাকে না পেলে আমাদের বাসা থেকে নানুকে নিয়ে যেতেন। আমরাও একটা নানু পেলাম আর নানুরও সময় ভালই কাটত। নানু আবার মেয়েদের তেমন পছন্দ করতেন না। আমার বড় ভাইকেই নানুর বেশি পছন্দ ছিল। তবে আমার নখ কাটা নানুর খুব পছন্দ ছিল।
নানু যখন সেই সবুজ মামার জন্য কাঁদতেন মায়ের খুব খারাপ লাগত। মা একদিন মামার সাথে ফোনে কথা বললেন। খুব বোঝালেন কিছু একটা। এরপর এক মাস পর মামা আসলেন বাংলাদেশে। কিন্তু সবুজ মামা উঠলেন তার সেই সৎ বোনের বাসায়। ওখানে তার ভাগ্নেরা আছে তাই। কিন্তু তাতে নানু একটুও অখুশী ছিলেন না। ছেলে এতদিন পর তাকে দেখার জন্য আসছে তাতেই নানু খুব খুশী ছিলেন। আমার মা অসন্তুষ্ট ছিলেন, তাই নিজেই মামাকে বললেন, আপনি এইখানে খালাম্মার সাথে থাকবেন যতদিন আছেন। মায়ের সাথে না থেকে অন্য বাসায় থাকছেন এটা কেমন কথা? মামা মায়ের শক্ত শক্ত কথায় কোনো রকম রাগ না করে মাকে সরি বলে তার বাক্সপেটরা নিয়ে চলে আসলেন নানুর বাসাতে। এরপর থেকে নানুর সেই সৎ মেয়ে মাকে একদমই সহ্য করতে পারতেন না। আর মাঝখানে আমার কষ্ট বেড়ে গেল। সকাল সকাল মামার জন্য ফ্লাস্কে করে গরম চা নাস্তা নিয়ে যেতে হত আমাকেই।
পরের দিকে খারাপ লাগত না কারণ, সবুজ মামা ছিলেন খুব মিশুক আর মজার মানুষ। খুব ভালবাসতেন আমাকে আর আমার বড় ভাইকে। আমি আমার বড় ভাই মামার ভাগ্নারা মিলে মামার সাথে ঘুরতে বের হতাম। এভাবে মামার সাথেও বেশ খাতির হয়ে গেল আমাদের পরিবারের। এরপর থেকে মামা সৎ বোনের বাড়ি ছেড়ে সারাদিন আমাদের বাসায় কাটাতেন। বিদেশী রান্না, ঘোরাঘুরি, সারা রাত গল্প এভাবেই কাটছিল দিন। হঠাৎ মা আবিষ্কার করলেন মামার বয়স ৪২ কিন্তু মামা বিয়ে করেন নি। তাই মা আর নানুমণি মামার জন্য পাত্রী খোঁজা শুরু করলেন।
মামা তো শুনে তখনই চলে যাবেন দেশ ছেড়ে। মা তখন মামাকে কী সব বুঝিয়ে রাজি করালেন। কিন্তু যেই পাত্রী ঠিক করলেন তাকে দেখে নানুও মত পাল্টে ফেললেন যে ছেলের বিয়ে দেবেন না। অন্তত আমার আম্মুর পছন্দে না। কারণ সেই মামি খুব শুকনা ছিলেন। প্রায় লাঠির মতই।
আমার মা মানুষকে খুব বোঝাতে পারতেন। মা বোঝালেন, দেখেন কেউ তো সবুজ ভাইকে ভরসা করে কারো মেয়ে দেবে না। যদি উনি আর না ফেরেন সেই ভয়ে। তাই এই মেয়েরা যখন দিতে চাচ্ছে এদেরকেই মেনে নেওয়া উচিৎ।
তো নানু রাজি হওয়ায় মামাও রাজি। বিয়ে ঠিক হল আমাদের বাসাতেই।
আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। ছোট ছোট মিনি স্কার্ট পরতাম তখন। আমার খালামণি নেপাল থেকে পাঠাতেন। আর মা বলতেন আমি এখনও পিচ্চিই আছি তাই ফ্রক আর মিনি স্কার্ট পরাতেন। মামার বিয়ের লোকরা যেদিন আসলেন সেদিনও আমি ঘরের পোশাকই পরেছিলাম।
মামির বড় ভাইয়ের একটা ছেলে এসেছিল, সে সেভেনে পড়ত তখন। এছাড়াও আরো মামির ভাগ্নাভাগ্নি যারা এসেছিল সবাই আমার চেয়ে বড়ই ছিল। কিন্তু মামির বড় ভাইয়ের ছেলে নাফিকে দেখলাম ঘুর ঘুর করে আমাকে দেখছে। যতক্ষণ ছিল কারণে অকারণে আমার আশেপাশে ঘুরছে।
আমি একটু ভাব নিলাম। দেখেও না দেখার ভান করছি। তো ছেলেটা আমাদের রুমের ভিতর এসে আম্মুকে বলল, আন্টি একটু পানি হবে? আম্মুর হাতে তখন খাবারের ট্রে। তাই আম্মু আমাকে বললেন, অন্তু নাফিকে এক গ্লাস পানি দাও তো মা।
আমি পানি দিলাম নাফিসের হাতে। ও পানিটা হাতে না নিয়ে আমাকে একবার ভাল করে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বলল, “তুমি এত ছোট স্কার্ট কেন পরেছ? একটু বড় বড় জামা পরে না—সালোয়ার কামিজ—ওইসব নেই তোমার?”
নাফির কথা শুনে আমার মেজাজটা খুব খারাপ হয়ে গেল কিন্তু আবার লজ্জাও লাগছিল। তাই চুপ করে ওর হাতে পানির গ্লাসটা দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বললাম, “নাই সালোয়ার কামিজ।”
ও বলল, একটাও নাই?
আমি বললাম, না…।
তখন ও বলল, তোমাদের বাসার টিএনটি নাম্বারটা একটু দাও তো?
আমি একটা কাগজে লিখে দিলাম। কাগজটা সাবধানে পকেটে ঢুকিয়ে ভিতরে চলে গেল নাফি। আমি লজ্জায় আর ওর সামনে গেলাম না। দেখাও হল না। কিন্তু ও আর আমাদের ফোনে কল দিয়েছে বলে মনে হল না। এমন কোনো ফোন আসেনি।
এরপর দেখা হল একেবারে বিয়ের দিন। বিয়ের সময় আম্মু বিয়ে উপলক্ষে আমাকে একটা পার্টি ফ্রক কিনে দিলেন। কিন্তু আমি বায়না ধরলাম সালোয়ার কামিজ কিনে দেওয়ার জন্য।
মা তো খেপে গেলেন। বললেন, “বুড়িদের মত সালোয়ার কামিজ কেন পরবে? যেটা কিনে দিয়েছি পরো।” বাধ্য হয়ে ফ্রক পরে বিয়েতে গিয়ে নাফির সাথে দেখা। ওরা গেট ধরল, হই চই করছে আমার দিকে লক্ষ্যই নাই কোনো। আমার সাথে ছিল আমার বয়সী সবুজ মামার একটা ভাগ্নি রিমি। এক সময় নাফি তার কিছু বন্ধু নিয়ে আমার আর রিমির সামনে এসে বলল, ও হচ্ছে অন্তরা আর ও রিমি। আমরা হাই হ্যালো করলাম। একটু একটু গল্প করলাম। কে কোথায় পড়ছে, কী কী করে ইত্যাদি ইত্যাদি…। তো সেই ভাবে জানলাম নাফি পড়ে আমার পাশের স্কুল মতিঝিল মডেলে। আর আমি পড়তাম আইডিয়ালে। রিমির সাথেই বেশি গল্প করছিল নাফি। রিমি অবশ্য ফ্রকই পরেছিল তারপরও নাফি ওর সাথেই বেশি কথা বলছিল। কিন্তু আমার দিকে তাকিয়ে। আমি একটু বিব্রত হচ্ছিলাম এই জন্য।
পরে বিয়ে শেষে আমরা মামিকে নিয়ে চলে আসলাম। কিন্তু বেশ অনেকদিন আমাদের এই বাসার মানুষ ওই বাসায় ওই বাসার মানুষ এই বাসায় ঘোরাঘুরি চলল। সেই কারণে অনেকবার আমার, নাফির আর রিমির কথাবার্তা হয়েছে।
বেশ অনেকদিন আর দেখা হয়নি। নাফি কখনও ফোনও দেয়নি। একদিন নাফি ওর আম্মুর সাথে স্কুলে যাচ্ছিল। আর আমি অনেকগুলো মেয়ের সাথে স্কুল থেকে ফিরছিলাম খুব হি হি হা হা করতে করতে। আমাদের বাসা পাশাপাশি এলাকায় ছিল তাই স্কুলে যাওয়া-আসার পথ একটাই। আন্টি আমাকে দেখে বললেন, বাহ তোমার তো অনেক সাহস, একাই বাসায় যেতে পারো!
আমি একা ছিলাম না। আমরা প্রায় ৯-১০জন একই ক্লাসের মেয়ে ছিলাম, সাথে আমাদের লিডার পাড়ার ক্লাস টেনে পড়া আপুও ছিলেন। তবুও আন্টি একা যাওয়ার কথা কেন বললেন না বুঝলেও মাথা পেতে মেনে নিলাম।
আন্টি বললেন, নাহ বাবা তোমার মায়ের মত আমার এত সাহস নেই। আমি আমার নাফিকে আনা-নেওয়া করি এখনও। নাফি একবারও মাথা উঁচু না করে দাঁড়িয়েছিল। আমি বাসায় চলে আসলাম আন্টিকে সালাম দিয়ে।
আমি তখন সেভেনের বার্ষিক পরীক্ষা শেষে ক্লাস এইটে ওঠার অপেক্ষায় আছি। বাসায় বসে শুয়ে কাটাচ্ছি হঠাৎ একটা ফোন আসল। রিসিভ করে হ্যালো বললাম, কেউ কথা বলে না শুধু নিঃশ্বাস নেওয়ার শব্দ। এভাবে ডেইলি তিন চারবার এই ফোনটা আসে। আম্মু সারাদিন বাসায় থাকে না তাই আম্মুর চোখে পড়ে না। সন্ধ্যার পর যখন আম্মু বাসায় থাকেন তখন ফোনটা আসে না।
তো একদিন আমি ফোনটা ধরে বললাম, আচ্ছা তুমি কে বলতে না চাইলে ফোন কেন করো। তুমি ছেলে হলে একটা বাটন প্রেস করো আর মেয়ে হলে দুইটা প্রেস করো। তো সে একটা করল। আমি আবার বললাম, আচ্ছা পরিচিত হলে একটা, অপরিচিত হলে দুইটা প্রেস করো। ও করল একটা। এইভাবে প্রায় ৬ মাস বাটন প্রেসের মাধ্যমে ও কথা বলল।
একদিন নানুর বাসায় গিয়েছি। তখন নানু আর মামি থাকতেন বাসায়। মামা চলে গেছেন। মামিকে একেবারে সুইজারল্যান্ড নিয়ে যাওয়ার জন্য কাগজ রেডি করতে। তো মামি তখন তার বড় ভাইকে ফোন করার জন্য ডাইরি খুলে ফোনের সামনে বসে ছিলেন। কাছে গিয়ে নাম্বারটা দেখে পরিচিত লাগল। কিন্তু বুঝলাম না কেন। আমাদের ফোন সেই সময় কলার আইডি ফোন ছিল। তাই টিএনটি ফোনে দেখা যেত কোন নাম্বার থেকে কল আসছে। আমি তৎক্ষণাৎ মুখস্থ করে নিলাম নাম্বারটা। তারপর তাড়াতাড়ি বাসায় এসে লিখে রাখলাম। অপেক্ষা করছি ওই ফোনটার জন্য। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। ফোনটা উঠিয়ে কথা বলছি, ৩০ সেকেন্ড পার না হলে কোন নাম্বার থেকে ফোনটা এসেছে সেটা উঠবে না। ৩০ সেকেন্ড কথা চালানোই এখন আমার একমাত্র লক্ষ্য।
নাম্বারটা উঠল, মিলিয়ে নিলাম। এই নাম্বারটাই। এর অর্থ এটা নাফি ছাড়া আর কেউ না। কিন্তু আমি নাফিকে কিছুই বললাম না। এভাবে ক্লাস নাইন পর্যন্ত আমরা বাটন প্রেস করে করে কথা বলতাম। আমার ভালই লাগত কারণ আমি জানি এটা নাফি, কিন্তু নাফি জানত না আমি যে জানি। আমি ওকে বলতামও না। কারণ নাফি যদি জানতে পারে যে, আমি জানি কে ফোনটা করছে, তাহলে সে আমাকে আর কল নাও দিতে পারে৷
এর মধ্যে আমার মা একটা ফ্ল্যাট কিনলেন সেইখানে আমাদের চলে যেতে হবে। সেটা ছিল মিরপুরে। অনেক দূর। এর আগে আমি মিরপুর এলাকার নাম শুনেছি চিড়িয়াখানা এলাকা হিসেবেই।
এত তাড়াতাড়ি মা সব ঠিক করলেন যে আমি কিচ্ছু টেরই পেলাম না। বাবাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যই নাকি যেই মাসে আমরা নতুন বাসায় উঠব তার কয়েকদিন আগে সবাইকে জানিয়েছিলেন। এটা আমার জন্য ছিল জোর কা ঝাটকা। কোনো সারপ্রাইজ আমার মধ্যে কাজ করছে না। এরপরও ফোন আসল, কিন্তু আমি নাফিকে বললাম না, আমি ওকে চিনতে পেরেছি, জানি এটা ওরই ফোন।
যেই এলাকায় ছোটবেলা থেকে বড় হয়েছি সেটা ছেড়ে আমরা মিরপুরের নতুন বাসায় উঠলাম। মামা মামিকে নিয়ে চলে গেলেন। আমি ক্লাস টেনে উঠলাম। অন্য স্কুলে এসে ভর্তি করিয়ে দিলেন মা। কোনো রকম দেরি না করে।
বাসা থেকে বের হতাম না, কারণ এখানে কাউকে চিনি না, এলাকাও চিনি না, কারো কাছে যাওয়ারও নেই, বাসায় নতুন টিএনটি লাইনও নেই। বাবার মোবাইল ছিল কিন্তু সাত টাকা প্রতি মিনিট কাটে, তাই কাউকে ফোন করলে টের পেয়ে যাবে—এসব কারণে ফোনও করিনি।
এর মধ্যে নাফির কথা ভুলেও গেছি। নানুমণি আমাদের সাথে চলে আসতে চাইলেন। অসুস্থ অবস্থায় আমাদের মিরপুরের বাসাতেই ছিলেন। দেখার কেউ ছিল না উনার। মারাও গিয়েছিলেন আমাদের বাসায়। মা খুব সেবা করতেন নানুকে। কিন্তু মামি যাওয়ার পর আর মামির বাপের বাড়ির কেউ যোগাযোগ করত না। নানু মারা গেলেন যখন আমি টেনে পড়ি। তখন মামা আসলেন উনার শ্বশুর বাড়ির লোকরা আসল, কিন্তু নাফি আমাদের বাড়িতে আসেনি তখন। ভেবেছিলাম দেখা হবে। নাফির ছোট বোন বলল, নাফি আসতে চেয়েছিল কিন্তু আন্টি নিয়ে আসেনি কারণ নাফি নাকি অনেক আগে থেকেই মরা বাড়িতে গেলে অনেক দিন ভয়ে অসুস্থ থাকে। এই জন্য ওকে জোর করে আন্টি রেখে আসছেন।
একদিন হঠাৎ যেই ডাইরিতে নাম্বারটা লেখা ছিল সেটা হাতে পড়ল। বাবার ফোনটা হাতে নিয়ে কল দিলাম। কারণ ততদিনে ফোনের কল রেট হয়ে গেছে তিন টাকা। কিন্তু ফোনের ওপারে মহিলা কণ্ঠে মেশিন বলছে, এই নাম্বারটি এখন অব্যবহৃত আছে। এর মানে টিএনটি নাম্বারটা আর নেই। ব্যবহার হচ্ছে না।
মিরপুর ছেড়ে তখন আমরা কল্যাণপুরে চলে আসলাম। আমার মা তার ফ্ল্যাটটা বিক্রি করে দিয়েছেন। আমার একটা ছোট ভাই হওয়ায় মা তার বিজনেস বন্ধ করে দিয়েছিলেন ততদিনে। আমি ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার্থী। বাবার জিপি নাম্বারটা চেন্জ না হওয়ায় সবুজ মামা প্রায় সুইজারল্যান্ড থেকে কল দিয়ে খবর রাখতেন আমাদের। অনেক বছর পর দেশে এসেছেন এবার, তাই আমাদের কল্যাণপুরের বাসায় আসলেন। মামা-মামির সাথে তাদের তিন বছরের ছেলে রাকিন। মামা-মামিকে অনেক বছর পর দেখার পর গল্প হচ্ছে, মামা আর আমি মিলে গরুর মাংস রান্না করলাম। আর মামার পিচ্চিটার দুষ্টামি তো চলছে সামনে।
হঠাৎ মামিকে নাফির কথা জিজ্ঞেস করলাম। মামি খুব সাবলীলভাবে বললেন, “কেন জানো না কিছু? গত বছর তো নাফি বাইক এক্সিডেন্টে মারা গেছে।”
আমি জাস্ট বাকরুদ্ধ হয়ে বসে থাকলাম। কী শুনছি এটা! গলা শুকিয়ে গেল, কথা বের হচ্ছে না। অনেক কষ্টে বললাম, “কীভাবে বাইক…?”
মামি একটু ভারাক্রান্তভাবে বললেন, নাফিস ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে ওর মামাদের কাছে চলে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। ওখানেই পড়াশুনা করবে, থাকবে এমন কথা ছিল। কিন্তু যাওয়ার ৪ মাস পরেই হঠাৎ একদিন ফোন আসে বাইক চালাতে গিয়ে এক্সিডেন্ট হয়ে স্পট ডেড। লাশটা দেশে আনেনি কেউ। ভাবি তো মরা মুখটাও একবার দেখতে পাননি ছেলের। খুব খারাপ ভাবে চেহারা নাকি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
আমি আর মামির সামনে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারলাম না। নিজের ঘরে চলে গেলাম। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম, ইশ ওইদিন কেন বললাম না, আমি জানি ফোনটা তুমিই করো! আমি তোমাকে চিনতে পেরেছি!!
আর কখনও শোনা হবে না, সেই দিনগুলিতে কী বলতে চেয়েছিলে তুমি?
যেদিন মামির কাছে নাফির মৃত্যুর কথা শুনলাম সেদিন থেকে এই দিনটাই আমার কাছে নাফির মৃত্যু বার্ষিকী হয়ে রইল। আমি এখনও জানি না নাফির মৃত্যুর মাস এবং তারিখ কবে।
রচনাকাল ২০১৪