রকি রোড সানডে (২)
পুরানো আমলের ইংলিশ লোকজনদের দেখছি, উনারা কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আমেরিকানদের দেখতেই পারেন না। - রকি রোড সানডে

পুরানো আমলের ইংলিশ লোকজনদের দেখছি, উনারা কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আমেরিকানদের দেখতেই পারেন না। - রকি রোড সানডে
এপ্রিল ১১, ২০১৪
আজকে স্বপ্নে ইয়ান ইয়ানরে দেখলাম। দেখলাম আমি ঘরের মধ্যে হলুদ রঙের শর্টস আর উলেন নীল মোজা পইরা ঘুরতেছি, আম্মা আইসা খবর দিলেন ইয়ান ইয়ান আসছেন। আমি আয়নার সামনে গিয়া তাড়াতাড়ি চুল-টুল আঁচড়াইলাম—কিছুক্ষণ আগেই ঘুম থিকা উঠছি কিনা, জামা-কাপড়ের কোনো ঠিক-ঠিকানা নাই। লাল লাল রঙের একটা শাড়ি পইরা ইয়ান ইয়ান বাসায় ঢুকলেন। উনার এক হাতে ফুলের তোড়া আরেক হাতে ক্রিম-চিজওয়ালা ক্যারট কেক।
—শুভ জন্মদিন, নাদিয়া।
ইয়ান ইয়ানের সাথে আমার পরিচয় হইছিল ২০০৪ সালে। আমার এক বন্ধুর মারফত। আমার সেই বন্ধু উনারে বড় একটা সবুজ রঙের লাউ হাতে শাহবাগের রাস্তা ধইরা প্রবল বেগে হাঁইটে যাইতে দেইখা উনার প্রেমে পইড়া গেছিলেন। ইয়ান আমারে ডাকেন নাদিয়া বইলা। আমার অন্য বন্ধুরা আমারে ডাকেন তিথি। আম্মা ডাকেন তিথং আর আমার বন্ধু তমা ডাকেন তিথু।
নাদিয়া ইসলাম
কোনোটার একটাও আমার ভাল লাগে না। আমার ডাক নাম ছিল প্রতীতি, আমার বড় ভাই পান্থ’র সাথে মিল দিয়া। আমার বাপে কইলেন, এত বড় নাম কেউ ডাকতে পারবে না, তাই প্রতীতির অঙ্গহানির মুসলমানি হইয়া নাম তিথি হইয়া গেল।
আমি দেখলাম টেবিলের উপর আরো একটা কেক। সাদা ফ্রস্টিং-এর নিচে আধা খাওয়া একটা রেড ভেলভেট। বুঝলাম, গত কালকে জন্মদিন ছিল নিশ্চয়ই আমার।
—এই কেক, আপনি বানিয়েছেন?
—না, না, বাপী আনছিল।
—ও, আচ্ছা। তো আমি কিন্তু আপনাকে আজকে রান্না করে খাওয়াব। সবকিছু নিয়ে এসেছি।
আমি তাকায়ে দেখলাম, সত্যি সত্যি, উনার হাতভর্তি শাক সবজি-লাউ, অর্ধেকটা কুমড়া, দুইটা বেগুন, আরো কী কী জানি। বাজারের ব্যাগের ভিতর থিকা শুয়োরের একটা মাথাও দেখা যায়।
উনি আমার বাসার পিছনের বাগানে গিয়া মাটি দিয়া একটা চুলাও বানায়ে ফেললেন খুব তাড়াতাড়ি। আমি একটা বেতের চেয়ার নিয়া বইসা উনার রান্নাবান্না দেখতেছি। উনি যে হুট কইরা বিয়া কইরা ফেললেন, এইসব নিয়া আলাপ করতেছি, এমন সময় শুনি পানির শোঁ শোঁ আওয়াজ। ইয়ান ইয়ান বামে তাকায়া কইলেন, “এই রে, জোয়ার আসছে। সবকিছু সরাতে হবে!”
কথা শেষ হইতে না হইতেই দেখি বাগানের ভাঙা দেয়াল দিয়া হুড়মুড় কইরা পানি ঢুইকা সবকিছু ভাসায়ে নিয়া যাওয়া শুরু করছে। আমি দৌড়ায়ে বাসায় ঢুকলাম, আমার উলেন মোজা পানিতে নষ্ট হয়া যাবে তো। ইয়ান ইয়ানের সঙ্গে তখন একটা পায়জামা পাঞ্জাবি পরা বাচ্চা পোলা, উনারা দুইজনে মিলা টানাটানি কইরা আস্ত শুয়োরটারে বাসায় ঢুকাইতেছেন। পানির সাথে বটি ভাইসা যাইতেছে দেইখা পোলা হাউ হাউ কইরা কাইন্দা উঠলেন, এইটা তার নানির বটি। বটি হারাইলে নানি উনারে বটি দিয়া কুপায়ে মাইরে ফেলবেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
তারপরেই দেখলাম আমি আর ইয়ান ইয়ান পাহাড়ি একটা রাস্তা ধইরা হাঁটতেছি। তখন সন্ধ্যামত। চারদিকে ভাল অন্ধকার। কেবল একটা দুইটা টিমটিমা বাতিওয়ালা দোকান দেখা যায় দূরে দূরে। হাঁটতে হাঁটতেই ইয়ান একটা লুঙ্গিপরা মোছওয়ালা ভদ্রলোক হইয়া গেলেন। স্বপ্নে উনারে খুব আপন আপন মনে হইল। আমারে জিগাইলেন, “এইদিকে কী? সবকিছু তো অন্ধকার, কিছুই তো দেখা যায় না! কই নিয়া যাও আমারে?”
—এইখানে লাল মোহন গাঙ্গুলীর বাসা। আজকে অটোগ্রাফ নিয়া আসবো উনার।
—লাল মোহন গাঙ্গুলীটা আবার কে?
—উনি একজন ডিফেন্স ব্যারিস্টার। খুব বিখ্যাত।
—হুঁ।
উনারে খুব একটা উৎসাহী লাগল না। আমি পাত্তা না দিয়া রাস্তা দেখতে দেখতে হাঁটতে থাকলাম। হঠাৎ দেখি রাস্তার উপর একটা সোনার পয়সা পইড়া আছে। পাশের মোছওয়ালা ভদ্রলোকরে এখন সৌমিত্রের মত লাগতেছে। বেহুদা খাটো, কুঁচকানো একটা পাঞ্জাবি পরা। আর বাদামী রঙের ট্রাউযার্স। আমারে বললেন, “উঠাও, উঠাও না, দেখো না আসল সোনা কিনা!”
আমি পয়সাটা হাতে নিয়া ঘুরায়ে ফিরায়ে দেখতেছি, এরমধ্যেই আমার পাশে চার-পাঁচজন মধ্যবয়স্ক গুণ্ডামত ভদ্রমহিলা আইসা জড়ো হইলেন। একজন পান্না সবুজ রঙের সালওয়ার কামিজ পরা, ওড়নাটা নীল। আমার মায়েরও এই রঙের একটা জামা আছে। উনি আমার দিকে আঙুল উঁচায়ে উঁচায়ে কইলেন, “এই মেয়ে, তুমি আমার পয়সা মারার ধান্দায় আছো, না? দাও, ফেরত দাও আমার জিনিস!” পাঞ্জাবিওয়ালা সৌমিত্র তখন আবার ইয়ান ইয়ান হইয়া গেছেন। উনি আমার কানে কানে কইলেন, “মেনোপোজ হওয়া মহিলাদের থেকে সাবধান!” বইলাই উনি দৌড় দিলেন একটা। কিছু না ভাইবা আমিও দৌড় দিলাম উনার পিছ পিছ।
পাহাড়ি সরু রাস্তা। দুইপাশে বড় বড় গাছ। আমি হাঁপাইতে হাঁপাইতে দৌড়াইতেছি। হঠাৎ সামনে তাকায়ে দেখি পান্না সবুজ মহিলা আমার দিকে ছুইটা আসতেছেন সামনের অন্ধকার থিকা। উনার হাতে ইয়ান ইয়ানের পোলার পানিতে ভাইসা যাওয়া বটি। আমি ঘুইরা আরেক দিকে দৌড় দিব, দেখি, মেনোপোজ হওয়া বাকি মহিলারা হাত মাথার উপ্রে তুইলা ছুইটা আসতেছেন আমারে ধরতে।
এরমধ্যেই পান্না সবুজ আমার চুলের ঝুঁটি ধইরা আমারে আটকায়ে ফেলছেন। আমি চুল ছাড়াইতে ছাড়াইতে উনার হাত থিকা বটি ছুটায়ে নিছি। পিছনের মহিলারা আমারে ঘিরা ফেলছেন এরমধ্যেই। তারা মুখ দিয়া অদ্ভুত শব্দ করতেছেন কেমন জানি। আমি সব শক্তি এক কইরা পান্না সবুজের ডান হাতে বটির ব্লেড বসায়া দিলাম। কড়াৎ কইরা একটা শব্দ হইল, তাকায়া দেখলাম, পান্না সবুজের গাঢ় লাল রক্তওয়ালা হাতের কব্জিটা আমার নীল চুলসহ রাস্তায় পইরা চকচকা চোখওয়ালা কই মাছের মত লাফাইতেছেন। উনিও চকচকা চোখ নিয়া অবাক হয়া তাকায়া আছেন হাতের দিকে। আমি সোনার পয়সা বুকের সাথে চাইপা ধইরা আবার দৌড় দিলাম। ইয়ান ইয়ানরে দেখলাম দূরে একটা ক্যাবল কারের তার ধইরা ঝুলতেছেন। উনি চিল্লায়ে আমারে কইলেন, সামনে একটা টানেল আছে, তার ভিতর দিয়া কাচ কাইটা আমারে এইখানে আসতে হবে।
আমি টানেলে ঢুকব, আমার বিড়াল আমার পা চাটাচাটি কইরা ঘুমটা ভাঙায়ে দিলেন। সবাইরে শুভ সকাল!
আমি একটা ছোট গল্প লিখব ভাবতেছি। গল্পের নাম এখনও ঠিক করি নাই। তবে নায়িকার নাম ঠিক করছি। বেলেছা। নামটা আসছে মাতাশ্রীর কাছ থিকা। মা’র স্কুলে বাথরুম পরিষ্কারের কাজ করেন এক মহিলা, উনার প্রাক্তন নাম বেলেছা। ঢাকায় আইসা বেলেছা নাম পাল্টায়ে বিউটি হইছেন। আম্মা জানাইলেন, উনি দেখতেও বিউটিফুল।
আম্মার বেশিরভাগ কথা আমি অবশ্য পাত্তা দেই না। উনার অতিরঞ্জনের সমস্যা আছে। উনার মাথাও অল্পবিস্তর খারাপ। দেড় দুইমাস আগে উনি সাতশ’ টাকা দিয়া একটা প্লাস্টিকের ডিম কিনছিলেন। দেখতে ও ওজনেও সেইটা আসল মুরগীর ডিমের মত। সেই ডিম নিয়া উনি উনার হাজব্যান্ড (আমার পিতৃদেব), উনার ছেলে (আমার ভাই) ও উনার ছেলের বউ (অর্থাৎ আমার বৌদি) এবং বাসায় যারা যারা আসছেন, তাদের কইছেন খোসা ছাড়ায়ে দিতে। উনি নিজে খোসা ছাড়াইতে পারতেছেন না, উনার আঙুলে সমস্যা। এর কিছুদিন পরে উনি এক শপিং কমপ্লেক্স থিকা কিনছেন একটা খেলনা ইঁদুর। যথারীতি এই ইঁদুরও আসল ইঁদুরের মত দেখতে। ভেলভেটের চামড়া, লোমওয়ালা লেজ, চোখগুলাও নড়ে। উনার ইচ্ছা কয়জন পায়ের নিচে পারা দিয়া এই ইঁদুর মারতে কত সময় নেন, এইটা আবিষ্কার করা।
তো যাই হোক, ঘটনার শুরুটা হবে এমন—বেলেছা বিয়া কইরা লন্ডন আসছেন। উনার স্বামীর নামটা এখনও ঠিক করি নাই। ধরা গেল উনার নাম ১। তো ১ আর বেলেছা সেভেন কিংসে একটা বাড়ি ভাড়া করছেন। বাড়িওয়ালির নাম মিসেস ক’ফিল্ড।
১
আজকে আমি আর ১ বাইরে খেতে যাব ভাবছি। বাসায় কোনো খাবার নাই। তিন দিনের পুরানো দুই টুকরা পাউরুটি আছে, তার এক কোণা দিয়ে সবুজ আর ছাইরঙা ফাঙ্গাস জমেছে। ১ জানে না, এখনও রুটিগুলি ফেলে দেই নাই আমি। সবুজ রঙটা যে কী অদ্ভুত সুন্দর! ও, আর ফ্রিজে আছে পিঁয়াজের গন্ধওয়ালা আধাবাটি মাখন। ১কে আমি অনেকদিন না করেছি তরকারির চামচ দিয়ে মাখন তুলতে। বলে লাভ নাই। ওর স্মৃতিশক্তির সমস্যা আছে। কাজের অর্ধেক করে চিন্তা শুরু করে, কী করছিল। ও অবশ্য নিজেই বলে ওর মেমরি নাকি গোল্ডফিশের থেকেও খারাপ। আমার একটা গোল্ডফিশ ছিল ছোটবেলায়। আমার নানা কিনে দিয়েছিলেন। তিনদিন অ্যাকুরিয়ামে থাকার পর এক শনিবার সে পেট ফুলে মরে গেল। আমি কাঁদি নাই, আমার ছোট বোন এক সপ্তা কেঁদেছিল।
আমার নানা আমার নাম দিয়েছিলেন বেলেছা। সেই নাম আমার আর নানা ছাড়া আর কারোর ভাল লাগে নাই। আমার আসল নাম রুবনা হোসেন। আমার বিয়ের দিন আমি ১কে বলেছি আমাকে বেলেছা নামে ডাকতে হবে। যদি না ডাকে, তাহলে আমি এখনই বিয়ে ভেঙে দিয়ে চলে যাব। ও খুব করুণ মুখে বলেছে, বেলেছা ডাকবে না ক্যানো? বেলেছা তো খুব সুন্দর নাম, ইত্যাদি।
আমি হাঁটু সমান একটা জিন্সের স্কার্টের উপরে হাতাকাটা লাল রঙের টপস্ পরলাম। লালের উপর সাদা পোলকা ডট। ১ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “এইটা কী পরছো? বাইরে যে বাতাস, একটা জ্যাকেট নিবা না সাথে? আর চুলটাও তো দেখি আঁচড়াও নাই!”
আমি উত্তর দিতে যাব, শুনি দরজার উপর টক টক টক টক অধৈর্য্য আওয়াজ।
এই সময় কে এসেছে? পোস্টম্যানরা তো বিকাল পাঁচটার পরে আসে না! এখন সাড়ে সাতটা বাজে।
১ জুতার ফিতা বাঁধতে বাঁধতে আমাকে বলল, “দেখতে পারতেছো না, কে? দেখ না কে আসছে!”
পাশের বাসার মহিলা নাকি এই ভাবতে ভাবতে আমি দরজা খুললাম। মহিলা উনার চাইল্ড মাইন্ডার না আসলে মাঝে মাঝেই মেয়েকে আমার কাছে রেখে যান। আমার বাচ্চাকাচ্চা ভাল লাগে না, কিন্তু মিথ্যা কথাও বলতে পারি না। আসলেই তো আমার করার কিছুই নাই।
বাড়িওয়ালি। মিসেস ক’ফিল্ড।
“হ্যালো! গুড আফটারনূন মিসেস ক’ফিল্ড!” আমি হাসলাম একটু।
মহিলার বয়স নব্বইয়েরও উপরে। সামনের তিনটা দাঁত নাই। ঘাড় পর্যন্ত লম্বা ফিনফিনে কটন ক্যান্ডির মত সাদা সাদা চুল। আমার বাসার লাইনের চারটা বাসা উনার। মার্গারেট থ্যাচারের সময় পানির দামে কিনেছিলেন সবগুলি। উনি থাকেন আমার পাশেরটায়। বাকি তিনটা ভাড়া দিয়েছেন। উনি মনে হয় আমার হাসি দেখতে পেলেন না। আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন, “তোমার লিভিং রুমের পর্দা কই?” উনার চোখ আমার ঘরের ভিতর।
—এক্সকিউস মি? কী কই?
—পর্দা, পর্দা, জানালার পর্দা!
“ও, হ্যাঁ, পর্দা?” আমি ১ এর দিকে তাকালাম একটু। এখনও ফিতা বাঁধছে সে। “ঘরে আলো ঢোকে না, তাই আমি খুলে ভাঁজ করে আলমারিতে রেখে দিয়েছি। কেন?”
—আমি চাই কালকেই তুমি জানালায় পর্দা লাগাও। বাইরে থেকে সব দেখা যায়। আমার বাড়িতে আমি কোনো ছোটলোক ভাড়া দিব না।”
“ছোটলোক মানে?” আমার গলা একটু উপরে উঠল।
“ছোটলোক মানে তোমরা। এশিয়ানরা। আজকে পর্দা খুলে ফেলবে, কালকে জানালায় তোমাদের লম্বা লম্বা শাড়ি আর ছেলেদের স্কার্ট শুকাতে দিবে! আমার বাসায় এইসব চলবে না!” এই বলতে বলতে উনি কার্পেটের মেঝেতে পা ঠুঁকলেন দুইবার।
এতক্ষণে ১ উঠে আসল। আমি তাকিয়ে দেখলাম ওর দু’পায়ের দুই জুতাতেই নিখুঁত সমান দু’টা বো। স্কেল দিয়ে মেপে ফিতা বেঁধেছে নাকি সে?
আজকে আর লিখব না। মিসেস ক’ফিল্ডের ক্যারেক্টারটা নিয়া চিন্তা করতে হবে। বাসায় আসলেই খাওয়ার কিছু নাই। একবছর আগে এক্সপায়ারি ডেইট ওভার হয়ে যাওয়া কিছু কর্নফ্লেক্স আছে। ফালায় দিব দিব কইরাও ফেলানো হয় না। আমার জিনিসপত্র জমানোর রোগ আছে।
এপ্রিল ১৫, ২০১৪
বেলেছার গল্পটা লিখব না ঠিক করছি। উনার গল্পে বার বার আমার গল্প চইলা আসতেছে। মিসেস ক’ফিল্ড ছিলেন আমার বাড়িওয়ালি। মার্গারেট থ্যাচারের সময় উনি আসলেই এই সেভেন কিংসের পাশাপাশি চারটা বাড়ি পানির দামে কিনছিলেন। এরমধ্যে তিনটা উনি ভাড়া দিছেন, একটায় নিজে থাকেন। উনার আর আমার বাড়ি পাশাপাশি। ভিক্টোরিয়ান বাড়িগুলি এখনও সেই রকম আছে, প্রায় ১৮ ফিট উঁচা দেয়াল, ঘরের ভিতরে আর্চ, বে উইন্ডো, স্লেটের ছাদ, স্টেইন গ্লাসের জানলা কোনো কিছুই উনি পাল্টান নাই।
প্রথম যেইদিন এই বাসায় ঢুকছি সেইদিনই আমি এই বাড়ির প্রেমে পইড়া যাই। ঘরে ঢোকার সাথে সাথে আমার মনে হইতে থাকে আমি চার্লস ডিকেন্সের ‘গ্রেট এক্সপেকটেশান’ বইয়ের ভিতর ঢুইকা যাইতেছি আর মিসেস ক’ফিল্ডরে মনে হইতে থাকে মাথা খারাপ মিসেস হ্যাভিশামের মত। কাল্পনিক মিসেস হ্যাভিশাম থাকতেন বিশাল এক প্রাচীন ম্যানশানে, তার কন্যা এস্টেলরে নিয়া। বিয়ার আসর ত্যাগ কইরা চইলা আসার পর থিকা উনি সারাজীবন কাটাইছেন বিয়ার সাদা জামা পইরা।
তো যাই হোক, বলতেছিলাম মিসেস ক’ফিল্ডের কথা। এইরকম ছোট সাইজের—হাড় জিরজিরা কুঁজা—দেখলেই আদর আদর লাগে এমন একজন মানুষের শরীরে যে এত রাগ এবং এত কবি নজরুলীয় তেজ থাকতে পারে তা উনারে দেখার পরেও বিশ্বাস করা অসম্ভব। দুনিয়ার সকল বিষয়ে উনার অভিযোগ ছিল। বরফ পড়লে অভিযোগ, গরম শুরু হইলে অভিযোগ, বৃষ্টি হইলেও অভিযোগ। কোনো কিছুর দাম বাইড়া গেলে অভিযোগ, এমনকি কমলেও অভিযোগ। কনজারভেটিভ সরকার নিয়া অভিযোগ, লিবারেলদের নিয়াও অভিযোগ।
উনারে সাইজে রাখার জন্য আমি বাড়িতে ওঠার প্রথম ইস্টারে উনার জন্য একটা চকলেটের বাক্স, একটা ফুলের বুকে আর একটা গ্রিটিং কার্ড ঘুষ নিয়া পাশের বাড়ি গেলাম। উনি আমার দিকে আগাপাশতলা ভাল কইরা তাকাইলেন যেন জীবনে এই প্রথমবার আমারে দেখতেছেন।
—তুমি ইস্টার পালন করো?
আমি একটু খুক কইরা কাইশা জুতার দিকে তাকাইয়া বললাম, “জ্বি না, আমি কোনো ধর্মীয় উৎসব পালন করি না।”
উনি আমার হাত থিকা ফুলের বুকে নিলেন। ফুলের গন্ধ শুঁইকা একটা হাঁচি দেওয়ার ভঙ্গি কইরা উনার পায়ের কাছে রাখা একটা বিনে জুতার কোনা দিয়া টোকা দিয়া খুইলা পুরা বুকেটা উপুড় কইরা ফালায় দিলেন। বললেন, “আমার ফুলে অ্যালার্জি আছে। উৎসব পালন করো না তাহলে এসব নিয়ে এসেছো কেন? আমাকে ঘুষ দিতে?”
আমি আমতা আমতা করতে লাগলাম। উনি এইবার হাত বাড়াইয়া চকলেটের বাক্স নিলেন। র্যাপিং আর ফিতা সরায়ে বাক্সের পিছনে লাগানো লেবেল পড়তে লাগলেন।
—থর্নটন? হুম! ভ্যানিলা ট্রাফল? হুম! ক্রিমি ফাজ? সুদিং কফি ফাজ? কফি? কফি কে খায়? এরকম বাজে ড্রিংক গরীব অশিক্ষিত আমেরিকানরা ছাড়া কেউ খায় বলে তো শুনি নাই! সল্টেড ক্যারামেল প্রেলিন? ক্যারামেল আবার সল্টেড হয় নাকি? ইচ্ছামত জিনিস বানালেই হ’ল? পৃথিবীতে এত বেশি শেফ হ’লে তো সমস্যা! দাম কত এটার?
—দাম?
—হ্যাঁ দাম। কেন দাম জিজ্ঞেস করা যাবে না নাকি? কোন্ সস্তা জিনিস আমাকে গছাচ্ছো সেটা আমার বুঝতে হবে না?
—ইয়ে, দাম তো মনে নাই। সব একসাথে কিনছিলাম মার্ক্স অ্যান্ড স্পেন্সার থিকা।
—সুপারশপ?
—জ্বি, সুপারশপ।
উনি বিরক্তিতে নাক মুখ কুঁচকায়ে মচর মচর মচর মচর শব্দ কইরা র্যাপিং পেপার আর ফিতাগুলিরে গুলটি পাকাইয়া আবার জুতার কোনা দিয়া টোকা দিয়া বিন খুইলা তাতে সব কিছু এমনভাবে ফালাইলেন, আমার মনে হইল সুপারশপে যাওয়ার জন্য উনি আমারে না এমনভাবে মোচড়ায়ে টোচড়ায়ে বিনে ফালায়ে দেন!
“এইসব ব্লাডি এ্যামেরিকান সুপারশপ এসে ব্রিটেনের পুরো বারোটা বাজিয়ে দিয়ে গেছে! একটা দোকানেই নাকি সবকিছু পাওয়া যায়! আমাকে বলো, যারা মাছ বিক্রি করে তারা উলেন সোয়েটার বিক্রি করে কীভাবে?”
সেই প্রশ্ন অবশ্য আমারও।
পুরানো আমলের ইংলিশ লোকজনদের দেখছি, উনারা কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আমেরিকানদের দেখতেই পারেন না। আমার কাছে একটা কেইস আসছিল, অক্সফোর্ড স্ট্রিটে এক টেক্সান টুরিস্ট ভদ্রলোক এক ৭০ বছরের বুড়া ইংলিশের কাছে রাস্তার ডিরেকশান চাইতেছিলেন। ইংলিশ ভদ্রলোক টেক্সান ভদ্রলোকের ‘ফানি’ ইংরেজি শুইনা রাস্তার উপরেই মারামারি শুরু কইরা উনার মাথা ফাটায়ে দেন। সেই ট্রায়াল একটা দেখার মত ট্রায়াল ছিল।
ডিফেন্স ব্যারিস্টার যতই কোর্টে উপস্থিত দর্শক এবং জাজরে উনার ‘বৃদ্ধ’ এবং ‘অপ্রকৃতস্থ’ ইংলিশ ক্লায়েন্ট যে ভুল কইরা এমন একটা রেইসিস্ট কাজ কইরা ফেলছেন বোঝাইতে চান, ততই ইংলিশ ভদ্রলোক হাত পা ছুইড়া বলা শুরু করেন, সকল আমেরিকানরা গাধা এবং আমেরিকানরা ইংরেজি ভাষার জাত মাইরা দিছেন, উনারা ‘হাফ’রে বলেন ‘হ্যেফ’ এবং এই কারণে সকল আমেরিকানদের সমুচিৎ শাস্তি দিতে হবে এবং উনি জাইনা বুইঝাই এই মারামারি করছেন ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।
ক্রাউন কোর্ট ইংলিশ ভদ্রলোকরে সাত বছরের জেল দেয়।
আমি আর কথা বাড়াইলাম না। কার্ডটা সন্তর্পণে পকেটে ভইরা বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম। যাইতে যাইতেই শুনলাম পিছন থিকা উনি আমার নাম ধইরা ডাকতেছেন।
আমি ভয়ে ভয়ে আবার পিছনে তাকাইলাম, না জানি এখন আবার সুপারশপে ফেরত গিয়া রিসিট নিয়া আসতে হয় কিনা! মিসেস ক’ফিল্ড ময়লা ফেলার বিনটা আমার দিকে বাড়াইয়া দিয়া বললেন, “এটা না নিয়ে কোথায় যাচ্ছো? তোমার ফুল তুমি নিয়ে যাও। এই জিনিস ফেলতে গিয়ে আমার আবার আগামি তিন দিন হাঁচতে হবে! এমনিতেই যন্ত্রণার হে-ফিভারের সিজন শুরু হচ্ছে!”
তো এই উনি রাত্রিবেলা আমাদের বাসার পিছনের আমার আর উনার বাগানের দেয়ালের গর্ত দিয়া ঢুইকা আমার বেডরুমের জানালার পিছে ঘাপটি মাইরে বইসা থাকতেন আমি কী কী করি দেখার জন্য।
উনার ধারণা ছিল আমি ঘরের মধ্যে হাতুড়ি পেরেক দিয়া দেয়াল ফুটা করি, বেআইনি ড্রাগের চাষ করি এবং কুকুর বিড়াল পালি। বিড়াল কুকুরের গুয়ের গন্ধ শুঁকার জন্য প্রায়ই উনি আমার বাসার পিছনে বিড়াল কুকুর স্টাইলে নাক টানতে টানতে হাঁটতেন। আমি কেন ঘরে পর্দা টাঙ্গাই না, ঘরে আন্ডারওয়্যার পইরা হাঁটি এই নিয়াও উনার বিশাল সমস্যা ছিল। আমি মাঝেমধ্যেই ভাবতাম কাউন্সিলরে ফোন দিব বা পুলিশ ডাকব। কী কী কারণে ডাকা হয় নাই তা এখন আর মনে নাই।
মানুষের কী কী মনে থাকে না বা কী কী মনে থাকে এইটা একটা আশ্চর্যজনক বিষয়। আজকে কোর্টে যাইতে যাইতে মনে হইল, এই যে একটানা দেড় বছর আমি হাসপাতালে ছিলাম, তার প্রায় কোনো কিছুই আমার মনে নাই। যা যা মনে আছে তা সব আশেপাশের মানুষদের কাছ থিকা ধার করা স্মৃতি।
তিন মাস আগে আমার একটা ব্লাড টেস্ট ছিল কিং জর্জ হাসপাতালে। হাসপাতাল থিকা বাইর হওয়ার পর এখন প্রত্যেক তিন মাস অন্তর অন্তর আমার ব্লাড দিয়া আসতে হয়। তো আমি আর রঞ্জু টিকেট হাতে বইসা আছি লাউঞ্জে। আমার নাম্বার ৯৭। এখন চলতেছে ৬১। রক্ত নেয়ার নার্সরা সবাই খুব ফুর্তিতে আছেন—কাজের তেমন কোনো আগ্রহ দেখা যাইতেছে না উনাদের মধ্যে। সম্ভবত উনাদের একজনের বাচ্চা বা বিয়া হবে সামনে। সবাই কিছুক্ষণ পর পর উনারে কংগ্রাচুলেট করতেছেন, উনার টেবিলে ফুল, চকলেট আর কার্ড দিয়া আসতেছেন, ব্লাড দিতে আসা রোগীর হাতে ইলাস্টিক ব্যান্ড বাইন্ধা রাইখা হাসতে হাসতে হবু মা বা হবু বউরে প্লাস্টিকের কাপে পানি আগায়া দিতেছেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি বইসা বইসা বেন গোল্ডএকরের ‘ব্যাড সায়েন্স’ পড়তেছি—আমার সামনে দিয়া লম্বা মতন খুব সুন্দর দেখতে কোবাল্ট নীল স্যুট পরা এক দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক হাঁইটে গেলেন। যাওয়ার সময় আমার দিকে তাকায়ে মাথাটা সামান্য নামায়ে হাসলেন অল্প একটু।
আমি রঞ্জুর দিকে তাকাইলাম। ইনারে কি আমি চিনি?
রঞ্জু মনে হইল একটু অবাক হইলেন, “তুমি আসলেই চিনতে পারতেছো না উনাকে?”
আমি মাথা নাড়লাম, “চিনার কথা নাকি?”
অত্যন্ত আশ্চর্য হইয়া রঞ্জু জানাইলেন এই ভদ্রলোক আমার হেমাটোলজিস্ট ছিলেন দেড় বছর। আড়াইদিন যাবৎ আমারে কাটাকাটি করার পরে আমারে ও আমার ভাইরে উনিই প্রথম খবর দেন আমার ক্যান্সার ধরা পড়ছে। উনি তখনও বিশ্বাস করতে পারেন নাই যে এই ডাক্তাররে আমার আসলেই মনে নাই।
আমি বইটার মলাট দেখতে দেখতে নিজের স্মৃতিশক্তির কথা ভাইবা ভাইবা আশ্চর্য হইলাম। অনেক আগে কোথাও পড়ছিলাম, নরম্যাল ডেলিভারির পরে মহিলাদের ব্রেইন নিজের সারভাইভালের জন্য লেবার পেইনের স্মৃতিটা নাকি পুরাপুরি মুইছা ফেলেন ব্রেইন থিকা। আমার ক্ষেত্রেও কি তাই হইছে?
(চলবে)