উত্তরাধুনিকতার বিপক্ষে
বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাসের বাইরে ভারতবর্ষীয় সমাজে পশ্চিমী আধুনিকতার উল্লেখযোগ্য কোনো প্রাসঙ্গিকতা অনুপস্থিত।

বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাসের বাইরে ভারতবর্ষীয় সমাজে পশ্চিমী আধুনিকতার উল্লেখযোগ্য কোনো প্রাসঙ্গিকতা অনুপস্থিত।
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের কাল থেকেই বাঙালির বিড়ম্বনা শুরু। নিঃসংশয়ে অনেকাংশে এর দায়িত্ব প্রাতঃস্মরণীয় শ্রীউইলিয়াম কেরির ওপরে অর্পণ করা যেতে পারে। জনশ্রুতি, ভদ্রলোক তারুণ্যে চর্মকারের পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। কিন্তু এক নিবিড় নিশীথে তিনি অকস্মাৎ খ্রিস্টভাবনা দ্বারা আক্রান্ত হন। পৃথিবীর সকল পাপীদের ভবিষ্যৎ-চিন্তায় তিনি উদ্বেগাকুল এক রাত্রিযাপন করেন। প্রায় বিনিদ্র রজনীর পরবর্তী প্রভাতে তিনি ঐকান্তিক পরিশ্রমে পৃথিবীর মানচিত্রে ভারতবর্ষ নামক ভূখণ্ডটিকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হন, এবং তার অবশিষ্ট জীবন ভারতবর্ষের পাপীদের বোধোদয়ের প্রচেষ্টায় ব্যয় করবেন বলে স্থির করেন। ভূপৃষ্ঠে অতিবাহিত তাঁর অবশিষ্ট সময় বাংলা ও ভারতের ইতিহাসের অংশ। প্রয়াত রবীন্দ্রভক্ত শ্রীপ্রমথনাথ বিশী তাঁর অতিকায় উপন্যাস ‘কেরী সাহেবের মুন্সী’তে উইলিয়াম কেরির প্রতি উচ্চবর্ণ বাঙালির শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।
উইলিয়াম কেরি-বিষয়ক প্রকৃত সমস্যার শুরু এর কিছুকাল পরে। বঙ্গভূমিতে পদার্পণের অব্যবহিত কাল পরেই শ্রীকেরি ভারতবাসীর অ-জ্ঞানের গভীরতায় বিমূঢ় বোধ করেন। শুধু খ্রিস্টজ্ঞান নয়, উক্ত অ-জ্ঞানের পরিসীমা এনলাইটেনমেন্ট যুগের ইউরোপীয় জ্ঞান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এ পরিস্থিতি সংশোধনের লক্ষ্যে কেরি খ্রিস্টজ্ঞানের সমান্তরালে অ-জ্ঞান ভারতবাসীর মধ্যে ইউরোপীয় ভাষা ও এনলাইটেনমেন্ট-উদ্ভূত জ্ঞানবিস্তারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।
ফয়সাল শাহ্রিয়ার
তাঁর সে উদ্যোগ অভাবনীয় গতিতে সাফল্য লাভ করে। বঙ্গবাসী খ্রিস্টজ্ঞানে বিশেষ ঔৎসুক্য প্রকাশ না করলেও ইউরোপীয় ভাষা ও পরিচ্ছদের প্রতি লক্ষণীয় আগ্রহ প্রদর্শন করে। ফলশ্রুতিতে লর্ড ম্যাকলের কালের পূর্বেই বিত্তবান বাঙালি শ্রেণীর একটি অংশ ইউরোপীয় ভাষা ও সাহিত্যে পারঙ্গমতা অর্জন করেন। স্বাভাবিকভাবেই বাংলা সাহিত্যে এর অনিবার্য প্রভাব পড়ে, যা সর্বদা সুখকর হয়নি। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম উল্লেখযোগ্য বাঙালি ঔপন্যাসিক স্যার ওয়াল্টার স্কটের প্রতিটি উপন্যাস পাঠান্তে তীব্র শিহরণ অনুভব করেন এবং বাংলার স্কট হওয়ার দৃঢ় সঙ্কল্প বক্ষে ধারণ করেন।
তাঁর প্রথম দিককার উপন্যাসে পূর্ব ভারত ও ব্রিটেনের ভূপ্রকৃতির এবং ইতিহাসের মধ্যে সমান্তরাল প্রবণতা আবিষ্কারে তাঁকে যথেষ্ট শ্রম এবং সময় ব্যয় করতে হয়। নব্যধারার প্রথম বাঙালি কবিও জন মিল্টন দ্বারা তীব্রভাবে মোহগ্রস্ত হন। দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁর মোহ মাত্রা অতিক্রম করে যায় এবং কেরির কালের দীর্ঘদিন পরে তিনি খ্রিস্টধর্ম, খ্রিস্টীয় নাম ও ইউরোপীয় পরিচ্ছদ ধারণ করেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেও সম্ভবত প্রথম জীবন ইউরোপীয় সভ্যতার কল্যাণকর দিক প্রসঙ্গে কিঞ্চিদধিক মোহগ্রস্ত ছিলেন। তবে তাঁর শেষ জন্মদিনে পঠিত ভাষণে (যা পরে ‘সভ্যতার সংকট’ নামে প্রবন্ধ আকারে প্রকাশিত হয়) রবীন্দ্রনাথ শেষ বয়সে ইউরোপ প্রসঙ্গে তাঁর বেদনার্ত মোহভঙ্গের কথা অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করেছেন।
কিন্তু ইউরোপ সম্পর্কিত বাংলা সাহিত্যের প্রধান সমস্যা শুরু হয় প্রথম মহাযুদ্ধ-পরবর্তীকালে। এ সময় কতিপয় তরুণ তাদের বক্ষাভ্যন্তরে রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করার আকুল বাসনা অনুভব করেন। এদের অধিকাংশই ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র এবং কেউ কেউ পরবর্তীকালে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক। দুই যুদ্ধের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের দিগভ্রান্ত ইউরোপের কণ্ঠস্বর টিএস এলিয়টকে এঁরা উচ্চমূল্যে নিজেদের নৌকার কাণ্ডারি নিযুক্ত করেন এবং রবীন্দ্রসমুদ্র অতিক্রমের আশায় অনিশ্চিত যাত্রা আরম্ভ করেন। দুর্ভাগ্যবশত এক ব্যক্তি ব্যতীত কেউ অন্য তীরে পৌঁছাতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না। উক্ত গোষ্ঠীর অপর একজন তাঁর কল্পনার হাত ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্ট অতিক্রম করে গ্রিক প্রাগৈতিহাস পর্যন্ত প্রসারিত করেন এবং গ্রিক দেবী আর্টেমিসকে স্বভূমিতে আনয়ন করে ভারতীয় উর্বশীর সঙ্গে একই সমতলে স্থাপন করেন।
বিভাগোত্তরকালে উপরোক্ত কাব্যভূমিই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের কবিগণ উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেন। অবশ্য পাকিস্তানপন্থী কবিতার একটি ধারাও তখন প্রবহমান ছিল, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে অব্যাহত সাহিত্যিক যোগাযোগের পটভূমিতে তার সাফল্যের সম্ভাবনা ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ। অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবন্ধকতা ছিল ঢাকার ‘ছোট শহরের’ চরিত্র, যা দু’দশক পূর্বে বুদ্ধদেব বসুকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা শেষ করেই কলকাতার উদ্দেশ্যে দ্রুত প্রস্থানে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
ঢাকা অনেক পুরোনো শহর হলেও ‘৭১ সাল পর্যন্ত তার পাড়াভিত্তিক ঘরোয়া ভাব কাটেনি। কলকাতার গলিতে পরিশ্রমসাধ্য অনুসন্ধানের পরে বোদলেয়ারীয় যন্ত্রণার চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেলেও পঞ্চাশের দশকের নওয়াবপুরে তা ছিল অনুপস্থিত। তবুও ঢাকার কবিতায় ক্রমশ আধুনিকতার পক্ষের ধারাটি বেগবান হয়ে ওঠে।
এ রকম একটি ক্রান্তিলগ্নে বুদ্ধদেব বসু দ্বিতীয়বারের মত ঢাকার কবিতার ত্রাণকর্তার ভূমিকায় আবির্ভূত হলেন। ‘আধুনিকতা’ প্রসঙ্গে যতোটুকু সংশয় তখনো পূর্বরূপে অবশিষ্ট ছিল বুদ্ধদেব বসুর বোদলেয়ারের কবিতার অনুবাদ তা নিমেষে দূরীভূত করলো। বুদ্ধদেব বসু উভয় বঙ্গেই ত্রিশের কবিতার সঙ্গে পরবর্তী প্রজন্মের প্রধান যোগসূত্র হিসেবে কাজ করেন। সুতরাং তাঁর কাছ থেকে বোদলেয়ারীয় ‘আধুনিকতা’-কে গ্রহণ করতে পূর্ববঙ্গীয় কবিদের দ্বিধাগ্রস্ত হতে হয়নি। ঢাকার আধুনিক বাংলা কবিতাকে এর পরে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
পরবর্তী তিন দশকে ঢাকার কবিতার মূলধারায় কোনো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেনি। ষাটের দশকের রাজনৈতিক ঘটনাবলী স্বাভাবিকভাবেই পূর্ববঙ্গের কবিতায় লক্ষণীয় প্রভাব রেখে যায়। যার ফলশ্রুতিতে কিছু স্মরণযোগ্য কবিতার জন্ম হয়। সত্তরের কবিরা স্বাধীনতাপ্রসূত উল্লাসে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেও তৎকালীন কবিতা মূলধারা থেকে বিচ্যুত হয়নি। আশির কবিতা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে নির্বাচিত সরকার পুনরুদ্ধারের আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে। তবে এ সময়ই পূর্ববর্তী ত্রিশ বছরের পূর্ববঙ্গের কবিতার মূলস্রোত নিয়ে বিবিধ সংশয় দেখা দেয়। ‘আধুনিকতা’র সঠিক তাৎপর্য তার মধ্যে অন্যতম। সম্প্রতি পূর্ববঙ্গে উত্তরাধুনিকতার (Postmodernism) কথা শোনা যাচ্ছে। উক্ত ধ্বনি ক্রমশই শক্তি সঞ্চয় করছে।
বিস্ময়কর নয় যে, বাঙালির চিন্তাজগতের বিভিন্ন ঘটনার মত উত্তরাধুনিকতার ধারণাটিও পশ্চিমাগত, এবং পশ্চিম গোলার্ধ থেকে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে বঙ্গ উপকূলে অবতরণ করতে তার যথেষ্ট সময় লেগেছে। কিন্তু নবাগত অতিথির কুলপরিচয় অদ্যাবধি স্পষ্ট নয়। পাশ্চাত্যে আধুনিকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মধ্যে অনেকখানি আবেগের আধেয় রয়েছে। একটি বিশেষ গোষ্ঠীর বিশ্বাস যে, পশ্চিমী আধুনিকতার ধারণাটি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পরিণত পর্যায়ে সোভিয়েত সাম্যবাদ ও জার্মান নাৎসিবাদের মূর্ত রূপ ধারণ করে, যার ফলাফল ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। উভয় রাষ্ট্রে ব্যক্তিস্বাধীনতা চরম নিগ্রহ ছাড়াও তাদের দ্বন্দ্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিপুল লোকক্ষয় এবং যুদ্ধশেষে ইউরোপের শক্তিলোপ—সবের দায়িত্বই হেগেলীয় আধুনিকতার ওপরে অর্পণের চেষ্টা করা হয়েছে। পাশ্চাত্যের একটি বিশেষ গোষ্ঠী তাই যে কোনো মূল্যে এ ধরনের আধুনিকতার দ্রুত পরিসমাপ্তি কামনা করেন।
কিন্তু পশ্চিমী আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতার ধারণাদ্বয় ইউরোপের গত কয়েক শতাব্দীর ইতিহাস থেকেই বৃদ্ধি লাভ করেছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ব্রিটেনের অর্থনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন—যা ব্রিটেনের সামাজিক-অর্থনৈতিক কাঠামোকে এক শতাব্দীকাল সময়ের মধ্যে বদলে দেয় এবং যা পরে ইউরোপের মূল ভূখণ্ডে পরিবাহিত হয়—এক অর্থে ইউরোপীয় আধুনিকতার ধারণাটি তারই প্রত্যক্ষ ফসল। অর্থনীতিতে কাঠামোগত পরিবর্তনের সমান্তরালে অগ্রসর হয় ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্টের ধারাটি। সামাজিক-অর্থনৈতিক কাঠামোর যুগান্তকারী পরিবর্তনের সঙ্গে ব্যক্তিমানুষের সঙ্গে বস্তুজগৎ ও সমাজের সম্পর্ক এবং এ সকল সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুক্তির ভূমিকা সম্পর্কিত ধারণার পরিবর্তন স্বাভাবিক ছিল। এ সকল পরিবর্তনের ফলেই ইউরোপে ক্রমশ আধুনিকতার ধারণাটি সুনির্দিষ্ট আকার ধারণ করে। উক্ত ধারণা দীর্ঘকাল পাশ্চাত্য সমাজের বৈষয়িক-অবৈষয়িক অগ্রগতির বাহন হিসাবে সফল ভূমিকা পালন করে। ১৯১৪ সালে ইউরোপীয় মানুষ প্রথমবারের মত বড় ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সর্বার্থেই পশ্চিমী সভ্যতার জন্য ছিল একটি ক্রান্তিলগ্ন। মানবমুক্তির কোনো স্বপ্ন অথবা অন্ধকারাচ্ছন্ন কোনো মহাদেশে ইউরোপীয় আলোক বিতরণ নয়, দৃশ্যত উক্ত মহাযুদ্ধের পিছনে সক্রিয় ছিল বিস্তারিত বাজার ও শিল্পের কাঁচামালের উৎসের জন্য সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপীয় শক্তিসমূহের দ্বন্দ্ব। নিশ্চিত ছিল যে, এ যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী এবং গুরুতর রূপে শক্তিক্ষয়ী হবে।
তৎকালীন যুদ্ধবিদ্যার বিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘস্থায়ী এ যুদ্ধের জন্য প্রয়োজন ছিল বিপুল সংখ্যক মানবজীবনের পরিসমাপ্তি, যার একমাত্র সম্ভাব্য উৎস ছিল ইউরোপীয় শিল্পশ্রমিক শ্রেণী। অর্থাৎ শাসকগোষ্ঠীর বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে প্রয়োজন ছিল বিপুলসংখ্যক শিল্পশ্রমিকের নিশ্চিত আত্মাহুতি। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের মধ্যে ইউরোপীয় শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক (Second International) লক্ষণীয় শক্তি সঞ্চয় করে। ইউরোপের পরবর্তী গতিপথ অনেকাংশে নির্ভর করছিল দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সিদ্ধান্তের ওপরে। সারাইয়েভোর ঘটনার ১ পরে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের জার্মান অংশ যুদ্ধপ্রচেষ্টায় যোগদানে সম্মতি প্রকাশ করলে দীর্ঘকালের জন্য পশ্চিম ইউরোপের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। চার বছরের জন্য ইউরোপীয় শক্তিসমূহ এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, যার পরিসমাপ্তিতে ইউরোপের মানচিত্র আমূল বদলে যায়। স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধশেষে ইউরোপ নিজেকে এক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আবিষ্কার করে।
পরাজিত শক্তিসমূহ ছিল শক্তিক্ষয়ের শেষ পর্যায়ে, কিন্তু বিজয়ীদের অবস্থানও আদৌ সুখকর ছিল না। বিপুল অর্থ ও লোকক্ষয় ব্যতীত ইউরোপীয় শাসকগোষ্ঠীর বাজার সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে শক্তির এই অপচয় সমগ্র সমাজকাঠামোকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে তোলে। অর্থাৎ কোনো জাতীয় অথবা মহাদেশীয় মতৈক্যের পরিস্থিতি আর বিদ্যমান ছিল না। বৈশ্বিক শক্তির ভরকেন্দ্রও ক্রমশ আটলান্টিকের অপর তীরে প্রস্থান করে।
এ ধরনের একটি পরিস্থিতিতেই ইউরোপীয় আধুনিকতা তার তুঙ্গ স্পর্শ করে। আস্থার ভূমি অদৃশ্য, তবুও আপাত দৃষ্টিতে সংশয়াচ্ছন্ন হলেও এলিয়ট ও জয়েস ইউরোপীয় সভ্যতার মূলধারার প্রতি তাঁদের বিশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করেন। স্মরণীয় যে, দুই যুদ্ধের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক-সামরিক উত্থান ঘটলেও চিন্তার জগতে তার উল্লেখযোগ্য বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি। কিন্তু দুই দশকের মধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমগ্র পরিস্থিতি বদলে দেয়।
এক অর্থে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল ইউরোপের শেষ আত্মঅবস্থানের প্রচেষ্টা। প্রথম মহাযুদ্ধের বিপুল শক্তিক্ষয়ের পরে কল্পনাতীত স্বল্প সময়ে পুনর্গঠিত জার্মানি রাজনৈতিক-সামরিক আধিপত্যের ক্ষেত্রে ইঙ্গ-মার্কিন মৈত্রীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হয়। ষষ্ঠবর্ষব্যাপী উক্ত দ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তিতে পূর্ববর্তী দুই শতাব্দীব্যাপী ইউরোপের উত্থানপর্ব সমাপ্তি লাভ করে। শুধু পরাজিত জার্মানিই নয়, বিজয়ী ইউরোপীয় শক্তিসমূহের পক্ষে তাদের ভূতপূর্ব উপনিবেশসমূহকে ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিক স্বাধীনতা প্রদানের কোনো বিকল্প থাকে না। ফলত স্বল্প সময়ের মধ্যে এশিয়া ও আফ্রিকার মানচিত্রে রাজনৈতিক স্বাধীনতাবিশিষ্ট অসংখ্য নতুন রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটে।
বিশ্ব-অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য অর্জন এবং পূর্ববর্তী উপনিবেশসমূহের রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভের সমন্বয়ে বিগত দুই শতাব্দীর বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং সমান্তরালে পুঁজিবাদী শক্তিসমূহের অভ্যন্তরীণ সামাজিক ভারসাম্যে অনিবার্য গুণগত পরিবর্তনের সূচনা করে। পুঁজিবাদের এই পর্বকেই পরিণত পর্যায়ে কেউ কেউ শিল্পোত্তর সমাজ (Post-industrial society) নামে আখ্যায়িত করেছেন। যে পর্যায়ের সঙ্গে উত্তরাধুনিকতার ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র রয়েছে।
কিন্তু গত পঞ্চাশ বছরে কি প্রকৃতপক্ষে বিশ্ব পুঁজিবাদের অবসান ঘটেছে? তা সম্ভবত নয়। লর্ড কেইনসের প্রদর্শিত পথে ২ ত্রিশের মহামন্দার আঘাতকে অতিক্রম করার পরে পুঁজিবাদ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একটি নতুন দীর্ঘস্থায়ী ভারসাম্যে উপনীত হয়েছে মাত্র।
পুঁজিবাদের প্রথম পর্বকে যদি যন্ত্রোৎপাদিত পণ্যের যুগ (মধ্য-উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত) এবং তার দ্বিতীয় পর্বকে যদি যন্ত্রোৎপাদিত যন্ত্রের যুগ (মধ্য-উনবিংশ শতাব্দীর পরে) বলা হয়, তাহলে পুঁজিবাদের তৃতীয় পর্বকে যন্ত্রোৎপাদিত কাঁচামাল ও খাদ্যের যুগ হিসাবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। প্রাথমিক ও মধ্য পর্যায়ে পাশ্চাত্যে সমাজ সম্পর্কের সঙ্গে সাংস্কৃতিক উপরিকাঠামোর সংযোগ থাকলেও তা ঠিক ‘উৎপাদনের’ পর্যায়ে যায়নি। কিন্তু তার তৃতীয় পর্যায়ে পুঁজিবাদ শুধু এশিয়া-আফ্রিকার কৃষি নয়, ইউরোপ-উত্তর আমেরিকার সংস্কৃতিতেও প্রত্যক্ষ আধিপত্য বিস্তার করেছে। পুঁজিবাদের বর্তমান পর্যায়ে প্রথমে ‘সাংস্কৃতিক’ পণ্যের বাজার সৃষ্টি করা হচ্ছে এবং পরবর্তীকালে প্রায় যন্ত্রোৎপাদনের মত ‘সাংস্কৃতিক’ পণ্য উৎপাদন করা হচ্ছে। টিএস এলিয়ট কোনোক্রমেই পুঁজিবাদের তৃতীয় পর্বের কণ্ঠস্বর হওয়ার গুণাবলী ধারণ করেন না। শিল্পোত্তর সমাজ হচ্ছে উত্তরাধুনিকতার লীলাক্ষেত্র।
জনশ্রুতি, আধুনিকতার দুই প্রধান মেটান্যারেটিভের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ থেকেই উত্তরাধুনিকতার উৎপত্তি। প্রথমোক্ত মেটান্যারেটিভ, অর্থাৎ ফরাসি বিপ্লবের মানবমুক্তির তত্ত্ব, যা নেপোলিয়ান তার বিজয়ী বাহিনীর সঙ্গে ইউরোপের সর্বত্র বহন করে নিয়ে এগিয়ে ছিলেন এবং যা সমগ্র ইউরোপে জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের জন্ম দেয়, তা বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে প্রায় অর্থহীন। পশ্চিমী আধুনিকতার অন্য প্রধান মেটান্যারেটিভ, অর্থাৎ হেগেলীয় চূড়ান্তবাদের তত্ত্ব, যা কালক্রমে তৃতীয় জার্মান রাইখে পরিণতি লাভ করে, বোধগম্য কারণেই পাশ্চাত্যের কাছে কোনো গ্রহণযোগ্যতা অবশিষ্ট রাখেনি।
কিন্তু পশ্চিমী আধুনিকতার প্রধান দুটি মেটান্যারেটিভ কখনও বঙ্গসমাজের জন্য প্রাসঙ্গিক ছিল কিনা, তা প্রণিধানযোগ্য বিষয়। ফরাসি বিপ্লবউদ্ভূত প্রথমোক্ত মেটান্যারেটিভটি সম্ভবত উনবিংশ শতাব্দীতে কোনো কোনো ভারতবর্ষীয় চিন্তাবিদ তাদের কল্পনায় ধারণ করেছিলেন। কিন্তু প্রথম মহাযুদ্ধের পরে যখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন চরম গতি অর্জন করে তখন এর উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা ছিল না।
প্রকৃতপক্ষে তৎকালীন নেতৃবৃন্দ উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনকে পশ্চিমী উদারনৈতিক গণতন্ত্রের মোড়কে সজ্জিত করার কোনো প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। ১৯৪২ সালে সে আন্দোলন চরম পশ্চিমবিরোধী আকার ধারণ করে। হেগেলীয় চূড়ান্তবাদের মেটান্যারেটিভটি সম্ভবত সর্বদাই ভারতবর্ষীয় সমাজের ক্ষেত্রে ছিল অধিকতর অপ্রাসঙ্গিক। এক অর্থে বলা যায় যে, ভারতবর্ষ বিংশ শতাব্দীতে একমাত্র সাম্যবাদী সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনেই আধুনিকতার প্রধান দু’টি মেটান্যারেটিভ মূর্ত রূপ গ্রহণ করে কিন্তু ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কালে তা যেমন সমাজ বিপ্লবের লক্ষ্যে নিবেদিত ছিল, তেমনি গত অর্ধ শতাব্দীতেও তা ভারতবর্ষের সামাজিক রাজনৈতিক মূলধারায় পরিণত হতে অক্ষম হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে গত দ্বিসহস্র বছরে ভারতবর্ষীয় ইতিহাসের গতি তার নিজস্ব দুটি মেটান্যারেটিভ দ্বারা নির্ধারিত হয়েছে: এক. সুষম রামরাজ্যের মেটান্যারেটিভ, যা হিমালয়ের দক্ষিণে আর্য আগমনের পরবর্তী ঘটনা; দুই. অল্পাধিক সহস্র বছরের পুরানো বিজয়ী ইসলামের মেটান্যারেটিভ। বর্তমানেও হিমালয় পরবর্তী জনগোষ্ঠীর জন্য উপরোক্ত দুটি মেটান্যারেটিভই সর্বাধিক প্রাণবন্ত ও প্রাসঙ্গিক বাস্তবতা। দীর্ঘকাল যাবৎ উক্ত মেটান্যারেটিভদ্বয়ের দ্বন্দ্ব অথবা সমন্বয়ের প্রচেষ্টার মাধ্যমেই ভারতবর্ষীয় সমাজের গতি নির্ধারিত হয়ে এসেছে। নব্বই দশকের ঘটনাবলীতেও তা বারংবার প্রমাণিত হয়েছে। অর্থাৎ বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাসের বাইরে ভারতবর্ষীয় সমাজে পশ্চিমী আধুনিকতার উল্লেখযোগ্য কোনো প্রাসঙ্গিকতা অনুপস্থিত।
মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, আধুনিকতার অপ্রাসঙ্গিকতার পরিপ্রেক্ষিতে আধুনিকতাকে অতিক্রমণের প্রচেষ্টাও লক্ষণীয়রূপে অর্থবহ নয়। বাংলাদেশে সম্ভবত কেউ কেউ একটি অদৃশ্য দেয়ালকে অতিক্রমের প্রয়াস পাচ্ছে। দুর্ভাগ্যবশত, হেগেলের কাছ থেকে নয়, বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘আধুনিকতাকে’ গ্রহণ করেছিলেন লরেন্সের কাছ থেকে। কৃতজ্ঞ পূর্ববঙ্গজন তা সশ্রদ্ধচিত্তে বুদ্ধদেবের কাছ থেকে বরণ করেছিলেন। উক্ত বুদ্ধদেবীয় আধুনিকতার দায় এখনও অনেকাংশে ভার হয়ে আছে। আশঙ্কা, উত্তরাধুনিকতার ক্ষেত্রেও কি তার পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে?
ভোরের কাগজ ১৯৯৭