হিউমার (Humor) শব্দের ইতিহাস
১৬৮০ সালের আগ পর্যন্ত কোনো কিছু “মজার” বা “হাস্যকর” বোঝাতে হিউমার শব্দ ব্যবহার করা হত না।

১৬৮০ সালের আগ পর্যন্ত কোনো কিছু “মজার” বা “হাস্যকর” বোঝাতে হিউমার শব্দ ব্যবহার করা হত না।
লাতিন ভাষায় “humor” বা হিউমার = “তরল পদার্থ বা স্যাঁতসেতে ভাব। মানব শরীরের চার ধরনের তরল (humors) বোঝানোর জন্যে এক সময় এই শব্দটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হত। তখন মনে করা হত এই চার তরল মানুষের আবেগ ও স্বভাব নিয়ন্ত্রণ করে। ১৬৮০ সালের আগ পর্যন্ত কোনো কিছু “মজার” বা “হাস্যকর” বোঝাতে হিউমার শব্দ ব্যবহার করা হত না। এই নিয়ে যদি আপনি আরও কিছু জানতে চান, তবে লেখাটি পড়তে থাকুন। আমি অবশ্য এই শব্দের ব্যুৎপত্তি খুঁজতে গিয়ে শব্দতত্ত্বের এক অসীম গহ্বরে তলিয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে আমি পাই আমার অপছন্দের কিছু শব্দ (কফ, পিত্ত, স্যাঁতসেতে)। এসব কারণে আমার শরীরও কিছুটা গুলিয়ে উঠেছে!
Humor। কী ভয়ানক রকম সমৃদ্ধ আর একই সঙ্গে জঘন্য একটি শব্দ।
যদি আপনি “চার হিউমার” (the four humors) ধারণার কথা শুনে থাকেন, যা আবেগ নিয়ন্ত্রণকারী শারীরিক তরল পদার্থ বোঝায়, তবে আপনি সম্ভবত এটি জেনে অবাক হবেন না যে ‘হিউমার’ (humor) শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ ‘উমোর’ (umor) থেকে, যার অর্থ ‘শারীরিক তরল’। এই ‘উমোর’ শব্দটি আবার ‘উমের’ (umere) থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ ‘ভেজা বা আর্দ্র থাকা’। এটি ইংরেজিতে ঢুকেছে ওল্ড নর্থ ফরাসি শব্দ ‘হিউমোর’ (humour) এর মাধ্যমে, যার সাধারণ অর্থ ছিল ‘তরল, স্যাঁতসেঁতে ভাব’ এবং যা ‘চার হিউমার’কেও নির্দেশ করত।
জেস জাফারিস
ইউসলেস এটিমোলজি, ২৯ নভেম্বর, ২০১৭
আপনার যদি humorism/humoralism বা “হিউমারবাদ” এর সঙ্গে পরিচয় না থাকে, তাহলে জেনে রাখুন—এটি ছিল এক ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি, যেখানে মানুষের আবেগ ও আচরণগত প্রবণতা ব্যাখ্যা করা হত চার রকম তরল পদার্থ দিয়ে। এই তরলগুলি হচ্ছে: রক্ত, কফ, পীত বা হলুদ পিত্ত (choler/yellow bile), আর কালো পিত্ত (melancholy/black bile)।
মনে করা হয় হিউমারবাদ (humorism) ধারণার সূচনা প্রাচীন মিশরীয় চিকিৎসা থেকে। পরে গ্রিক চিকিৎসক ও দার্শনিকেরা এই তত্ত্বকে একটি নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসেন। একটি অভিমত ছিল এরকম যে, রক্ত জমাট বাঁধার পর তা পরীক্ষা করে এই চারটি হিউমার বা তরল পদার্থ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। যদি কোনো কাচের পাত্রে রক্ত রেখে দেওয়া হয় তবে ঘণ্টাখানেক পর সেখানে এই চার ধরনের তরল পদার্থের স্তর তৈরি হয়।
মূলত হিপোক্রাতেস (Hippokratēs) এর কাজ থেকে হিউমারবাদ তত্ত্ব তৈরি করা হয় (এই চার ধরনের হিউমার বের করার কৃতিত্ব তাই হিপোক্রাতেসের)। তবে এই বিষয়টি এম্পেদোক্লেইস (Empedoklēs) এবং আরিস্ততেলেস (Aristotélēs) এর চারটি মৌলিক উপাদান (মাটি, আগুন, বাতাস, পানি) ও গ্যালেনোস এর কাজের সঙ্গেও যুক্ত ছিল। গ্যালেনোস মানুষের আচরণ ব্যাখ্যা করেছিলেন তাপমাত্রা এবং স্যাঁতসেতে ভাবের ভারসাম্যের ওপর ভিত্তি করে। প্রতিটি হিউমারের সঙ্গেই যুক্ত ছিল চারটি বিষয়: একটি প্রাকৃতিক উপাদান, একটি ঋতু, একটি বয়স, তাপমাত্রা/আর্দ্রতার মাত্রা এবং শরীরের একটি অঙ্গ যেটি হিউমার তৈরি করে বলে মনে করা হত।
মানুষের শরীরে এই তরলগুলির ভারসাম্যহীনতা বিভিন্ন সমস্যা বা খারাপ স্বভাব ও মানসিক অবস্থার কারণ হিসাবে ধরা হত। এই ভারসাম্যহীনতাকে ব্যবহার করা হত বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে স্বভাবগত পার্থক্য ব্যাখ্যা করার জন্যেও।
বিষয়টি মজার (আর একটু পিচ্ছিলও!), তাই আমি ঠিক করেছি অল্প করে হলেও প্রতিটি হিউমারের শব্দের উৎস (etymology) আর তাদের প্রভাব নিয়ে আপনাদের জানাব।
রক্ত (blood)
একটি সত্যিকারের খুবই পুরাতন শব্দ—ইংরেজি “blood” এসেছে প্রোটো-জার্মানিক blodam থেকে, যা আবার এসেছে প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপীয় (PIE) মূল bhlo-to- থেকে। এই মূলের অর্থ সম্ভবত ছিল “ফুলে ওঠা, গড়িয়ে পড়া, ছিটকে বের হওয়া” / “যা হঠাৎ ফেটে বের হয়।” (মজার ব্যাপার হল, এই মূলটি PIE শব্দ bloma বা “ফুল”-এর সঙ্গে সম্পর্কিত, যেটি একই ধরনের বাইরের দিকে প্রস্ফুটনের ধারণা বহন করে।)
চার ধরনের হিউমারের একটি ছিল রক্ত। এটি যুক্ত ছিল বায়বীয় উপাদানের সঙ্গে। রক্তের সঙ্গে যুক্ত ছিল আবার গরম ভাব, ভেজা ভাব, বসন্ত ঋতু আর শৈশবও। ধরা হত, যাদের শরীরে রক্ত বেশি, তারা “স্যাঙ্গুইন” ধরনের মানুষ। এই “স্যাঙ্গুইন” মানে আসলে “রক্তাক্ত”, কিন্তু এটি দিয়ে এমন মানুষকেও বোঝানো হত যারা খুব বেশি খুশি থাকে বা সহজে প্রেমে পড়ে যায়।
রক্ত আর এর সঙ্গে যুক্ত আবেগ যকৃত থেকে তৈরি হয়, তখনকার ধারণা এমনই ছিল। প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগীকে “bleeding” বা রক্ত বের করে চিকিৎসা করা হত, কারণ ভাবা হত এর ফলে শরীরে রক্তের ভারসাম্যহীনতা ঠিক হয়ে যাবে।
কফ (phlegm)
শব্দটি কোথা থেকে এসেছে, সেটির ইতিহাস জঘন্য রকমের রিক-অ্যান্ড-মর্টি* কিসিমের প্যাঁচালো। আসলে, শব্দটি ইংরেজিতে ঢুকেছিল fleem নামে, অনেকটা ফেনার মত রূপে। এটি ছিল ১৪ শতকের একটি শব্দ, যার মানে হল “ঘন (আঠালো, চটচটে) কফ বা শ্লেষ্মা।”
গ্রিক শব্দ phlegma থেকে Fleem শব্দটি এসেছিল। এটিও ছিল চার হিউমারের একটি। এর মানে ছিল “তাপে সৃষ্ট হিউমার,” কারণ এর উৎস শব্দ phlegein, যার মানে “পুড়তে থাকা।”
তবে মজার ব্যাপার হল, পোড়ার ব্যাপার থাকা সত্ত্বেও phlegmatic হিউমার ছিল ঠাণ্ডা ও স্যাঁতসেতে বৈশিষ্ট্যের প্রতীক। এর ঋতু ছিল শীতকাল, উপাদান ছিল পানি এবং বয়সকাল ছিল প্রাপ্তবয়স্ক। (এই তাপ বনাম ঠাণ্ডার বিরোধ হয়ত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হিউমারবাদী দর্শনের পরিবর্তনের ফল।) মনে করা হত কফ তৈরি হয় মস্তিষ্ক এবং/অথবা ফুসফুসে, আর এই তরলের ভারসাম্য হারালে মানুষ উদাসীন হয়ে পড়ে। এজন্যই phlegmatic শব্দটি আধুনিক ইংরেজিতে মানে হয় “শান্ত, স্থির, আত্মনিয়ন্ত্রিত” অথবা “ঠাণ্ডা, নিস্পৃহ, নিরাসক্ত।”
ব্যাপারটি একটু উল্টা মনে হতে পারে। কারণ এর সাথে ‘পোড়া’ বা ‘দহন’ (burn)-এর একটি যোগ আছে। তা সত্ত্বেও, কফ-ধাতুকে (phlegmatic humor) ঠাণ্ডা আর ভেজা ভাবা হত। একে শীতকাল, পানি আর পরিণত বয়সের সাথেও মেলানো হত। (সময়ের সাথে সাথে পুরানো তত্ত্ব বদলানোর কারণে হয়ত গরম আর ঠাণ্ডার এই অসামঞ্জস্যটি এসেছে।) আগেকার দিনে লোকে ভাবত কফ তৈরি হয় মাথা অথবা ফুসফুসে। এটিও মনে করা হত যে, শরীরে এর পরিমাণে গণ্ডগোল হলে মানুষ উদাসীন হয়ে পড়ে। এই ধারণা থেকেই কিন্তু এখন ইংরেজিতে ‘ফ্লেগমেটিক’ (phlegmatic) শব্দটির মানে দাঁড়িয়েছে “ঠাণ্ডা মাথার, শান্ত, স্থির” অথবা “অনুত্তেজিত, নিরস, উদাসীন।”
পীত / হলুদ পিত্ত (Choler/Yellow bile)
‘কোলের’ (Choler) শব্দটি স্বভাবতই কলেরা রোগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যা ক্ষুদ্রান্ত্রের একটি সংক্রমণ। এই শব্দটিও চতুর্দশ শতাব্দীতে উদ্ভূত এবং এর আদি অর্থ ছিল ‘পিত্তজনিত মেজাজ বা বর্ণ’। এখানে ‘পিত্তজনিত’ (bilious) বলতে বোঝায় কিছুটা বিবর্ণ বা অসুস্থতার ভাবযুক্ত চেহারা, যার উৎস গ্রিক শব্দমূল ‘খোল’ (khole) বা ‘পিত্ত’ (bile)। এই ‘খোল’ শব্দটি আবার আসছে ‘ক্লোরোস’ (khloros) থেকে, যার অর্থ ‘ফ্যাকাশে সবুজ, সবুজাভ-হলুদ’।
পরবর্তীকালে, ১৫০০ শতকের শেষ নাগাদ, ‘কোলেরিক’ (Choleric) শব্দের অর্থ পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়ায় ‘সহজে ক্রুদ্ধ’ বা ‘বদমেজাজি’। এই ধারণানুযায়ী, যাদের শরীরে হলুদ পিত্ত বেশি
থাকত, তাদের মনে করা হত খিটখিটে ও রাগী স্বভাবের। এই হিউমারের ঋতু হচ্ছে গ্রীষ্মকাল। বয়স যৌবন, উপাদান আগুন। আর তাপমাত্রা উষ্ণতা ও শুষ্কতার সঙ্গে সম্পর্কিত। এবং বিশ্বাস করা হত যে এর উৎপত্তি ঘটে প্লীহা (spleen) থেকে (এ কারণেই ‘স্প্লিন’ শব্দটি ক্রোধ বা বিরক্তি অর্থেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে)।
বিষাদ / কালো পিত্ত (Melancholy / black bile)
খেয়াল করলে দেখবেন, “choleric” আর “melancholy”-এই দুই শব্দেই chol আছে। বিষয়টি মোটেই কাকতালীয় নয়। Melancholy শব্দের আক্ষরিক মানে হল “কালো পিত্ত।” এটি এসেছে গ্রিক শব্দ melan থেকে। melan এর অর্থ “কালো” (আপনি melanin কথাটি শুনেছেন, যা প্রাণীদের melanism সৃষ্টি করে)। এর সাথে যুক্ত হয়েছে khole (পিত্ত)।
স্বাভাবিকভাবেই, যাদের শরীরে কালো পিত্ত বেশি ছিল, ভাবা হত তারা দুঃখ ও বিষণ্ণতায় ভোগে। এই হিউমারের সাথে সম্পর্কিত ঋতু শরৎকাল, বয়স প্রাপ্তবয়স্ক, তাপমাত্রা ঠাণ্ডা ও শুষ্ক আবহাওয়া এবং উপাদান হচ্ছে মাটি। ধারণা করা হত, এই কালো পিত্ত তৈরি হয় পিত্তথলিতে (gallbladder)।
(তাহলে কি ডিপ্রেশন সারাতে পিত্তথলি কেটে ফেলতে হবে? আরে না, মজা করলাম আরকি!)
চিকিৎসা বিজ্ঞান উন্নত হওয়ার পর এবং রসবাদ (humorism) তত্ত্ব বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগনির্ণয়ের একটি অকার্যকর উপায় হিসাবে প্রমাণিত হওয়ার পর, ১৫২০-এর দশকে এই বিভিন্ন ‘হিউমার’ বা ধাত থেকেই শব্দটি একটি সাধারণ ধারণা হিসাবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে, যার অর্থ দাঁড়ায় ‘মেজাজ বা মানসিক অবস্থা’।
১৬৮০-এর দশকেই প্রথম ‘হিউমার’ শব্দটি মজাদার, কৌতুককর বা হাসির কিছু বোঝাতে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। এই অর্থটি আসছে ‘হিউমার’ শব্দের ‘মেজাজ’ অর্থ থেকে (যেমন: “I am in an ill-humor/good humor.”)। এই ‘মেজাজ’ অর্থ থেকে পরে কারও মেজাজ বা খামখেয়ালের ‘তোয়াজ করার’ (humoring) ধারণাটি আসে। অবশেষে, এই শব্দ এমন কিছু বোঝাতে ব্যবহৃত হতে শুরু করে যা হাসিয়ে মেজাজ ভাল করে দেয়—যেমন কোনও রসিকতা বা হাসির নাটক।
এইচ. ডব্লিউ. ফাউলারের ১৯২৬ সালের মডার্ন ইংলিশ ইউসেজ (Modern English Usage) বইতে থাকা এই টেবিলটি বিভিন্ন ধরনের রসিকতা (wit, sature, sarcasm, ইত্যাদি) আলাদাভাবে চেনার একটি মজার উপায় দেখায়।
—
* আমেরিকান অ্যাডাল্ট অ্যানিমেটেড টিভি সিরিজ রিক অ্যান্ড মোরটি (Rick and Morty)। প্রতিভাবান কিন্তু পাগলাটে বিজ্ঞানী রিক আর তার কিছুটা গুবলেট ও ভীতু নাতি মোরটি। তারা একসাথে টাইম-ট্রাভেল, মাল্টিভার্স অভিযান, এলিয়েন দুনিয়া এবং নানা বৈজ্ঞানিক উদ্ভট ঘটনার মধ্য দিয়ে যায়। সিরিজে সাই-ফাই গল্পের সঙ্গে থাকে তীব্র ব্যঙ্গ, অদ্ভুত পরিহাস আর অনেক সময় ঘৃণার রস (gross-out humor)। এর স্টাইল খুবই অনন্য, ডার্ক হিউমার-প্রধান এবং অনেক দর্শক এটিকে মনে করেন “উন্মাদনার ভিতরে দর্শন”। সিরিজের নেটফ্লিক্স লিংক: সিজন ০১, এপিসোড ০১।
অনুবাদ: জেনারেটিভ এআই | সম্পাদনা: সাহিত্য ডেস্ক