১৯৯৫ সালের জানুয়ারি মাসের ৪ তারিখ আমি আর আমার সাহিত্যিক বন্ধু ও কলিগ রাজু আলাউদ্দিন হাজির হইলাম কথাশিল্পী শওকত ওসমান এর তখনকার মোমেনবাগ, শান্তিনগরের বাসায়—ইন্টারভিউ নিতে। দুপুরের দিকে। উনি তখন ঘুমাইতেছিলেন। যাওয়ার আগে রাজু টেলিফোন করছিলেন ওনারে বাংলাবাজার অফিস থিকা। তারপরেও উনি বিরক্ত হইলেন আমাদের দেইখা। হঠাৎ ঘুম ভাঙার বিরক্তি।

ওনার বয়স তখন ৭৮ বছর হইছে। ৭৮ বছর ২ দিন। ১৯১৭ সালের দোসরা জানুয়ারি জন্ম ওনার। একটা ছোট ঘরে তিনি থাকতেন। ছবির এই ঘরটাই। আমাদেরকে এর আগে তিনি দেখেন নাই কখনও। তবে রাজুর নাম জানতেন। গুইনা দেখলাম, সেইটা প্রায় ৩০ বছর আগের ঘটনা।


সাক্ষাৎকার. রাজু আলাউদ্দিন ও ব্রাত্য রাইসু


তার বছর খানেক বা কিছু বেশি আগে আমি সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকায় চাকরি শুরু করি। রাজু বোধহয় কিছু পরে যোগ দেন। উনি যোগ দেওয়ার পরে আমরা দুই সাহিত্যিক বন্ধু মিল্লা মতি ভাইয়ের অনুমোদনে “সাক্ষাৎকার” নামে একটা বিভাগ বা পাতা চালু করছিলাম। সেইখানে বিখ্যাত কিছু রাজনৈতিক ও জাতীয় ব্যক্তিত্ব এবং শিল্পী-সাহিত্যিকের ইন্টারভিউ নিছিলাম আমরা। যেমন শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সাইফুর রহমান চৌধুরী, গাজী শামসুর রহমান প্রমুখের।

ইন্টারভিউ নেওয়াটা তখন আমাদের নেশার মত ছিল। আমি অবশ্য তারো ৫ বছর আগে থিকা ইন্টারভিউ নেই, আরম্ভ চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেনরে দিয়া, সাল ১৯৯০।

তো আমাদের সাক্ষাৎকার বিভাগের শুরুটা ঘটছিল শওকত ভাইয়ের সাক্ষাৎকার দিয়া। রাজু টেলিফোনে ওনার সম্মতি নিয়া রাখছিলেন। ছোট খোলা নর্দমা সজ্জিত একটা মোটামুটি প্রস্থের ঘাসবহুল গলি পার হইয়া শওকত ওসমানের বাসায় গিয়া দেখি উনি ঘুমাইতেছেন। ওনার দেখাশোনা করেন এমন একজন লোক ওনারে ডাইকা দিলেন। আমরা সংক্ষিপ্ত একটা ঘরে গিয়া বসলাম।

এখানে উল্লেখ করা ভাল, এই ইন্টারভিউর পরে শওকত ওসমানের সঙ্গে আমাদের মধুর সম্পর্ক তৈরি হইছিল। উনি তখন অনেক দিনই সকালবেলায় ফোন কইরা, ঘুম ভাঙাইয়া, কুশল জিজ্ঞাসা করতেন। দেশরে ‘মৌলবাদমুক্ত’ রাখার জন্যে লেখকদের কী কী করা উচিত, সেই উপদেশ দিতেন। এবং আক্ষেপ করতেন।

বইমেলায় দেখা হইলে ওনার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতাম আমি। কিন্তু উনি শ্রদ্ধা-ট্রদ্ধার ধার ধারতেন না। বন্ধুর মতন কথা বলতেন।

আমি আর রাজু তখন যেসব ইন্টারভিউ নিছিলাম, সেগুলিরে ধীরে সাহিত্য ডটকম ও সাক্ষাৎকার্স ডটকমে পুনরায় প্রকাশ করার আশা রাখি। আপনাদের কেমন লাগল ইন্টারভিউ, তা কমেন্টে জানাবেন।

ব্রাত্য রাইসু, ১১/৭/২০২৫

শওকত ওসমান

তোমার তো কনট্রিবিউশনই নেই গত সাতশো-আটশো বছরে। কিছুই নেই তোমার। আর ওই ঐতিহ্যের দিকে তাকিয়ে… “আমি এই আছিলাম, ওই আছিলাম!”

শওকত ওসমান

ব্রাত্য রাইসু

ভাল আছেন কি?

শওকত ওসমান

ওটা (টেপরেকর্ডার) অন করেছ?

রাজু আলাউদ্দিন

কেন, অস্বস্তি বোধ করছেন?

শওকত

না না, আমি করছি না। ভাল আছি। আর এসব করতে হলে আগে থেকে ঠিক করে রাখতে হবে যে আমি এসব এসব চাই। হঠাৎ বলো না কী তোমার জিজ্ঞাস্য?

রাইসু

নির্দিষ্ট জিজ্ঞাস্য কিছু না, আপনার সাথে কথা বললাম, এই আর কি।

শওকত

এটা মিনিংলেস হয়ে যায় তো অনেক সময়। তোমাদের উদ্দেশ্য যদি না থাকে তা অনেকক্ষণ ধরে কথা বললাম, মানে কী? আমিই বা কী কথা বলব?

রাইসু

আমরা চাইছি আপনাকেই ধরতে। আপনার কোনো বিশেষ ব্যাপারে আপনার কোনো উত্তর আমরা আশা করছি না। আপনার কথা বলার মাধ্যমে আপনি চলে আসলেন—এই আর কি।

রাজু

না, ওসমান ভাই যেটা বললেন, উদ্দেশ্যটা বড় ব্যাপার বটে।

শওকত

পরিচয়টা তো দিতে হবে। তোমরা নাগরিক হচ্ছো… বলো কী নামটা?

রাজু

আমার নাম রাজু আলাউদ্দিন।

শওকত

আরে ভাই, তুমি খুব চেনাশোনা লোক। এটা আগে বলবে তো। তিনশ বছর হয়েছে তো একেবারে গ্রাম্যতা যায়নি।

রাইসু

আমাদের?

শওকত

মানে কলকাতা শহরের। এটা তো গ্রাম থেকে এইমাত্র একটু…।

রাইসু

আপনি গ্রাম্যতার বিরুদ্ধে?

শওকত

গ্রাম্যতা মানে কী, সমাজের তো কতগুলো নর্ম হয়ে যায়। গ্রাম্যতা বলতে গ্রামের বিরুদ্ধে কিছু বলা হচ্ছে না। তার আউটলুকের ওপর বলা হচ্ছে। যেজন্যে চাঁদে গিয়ে… এটা তো অনেকবার বলেছি—আমেরিকান-রাশিয়ানরা যখন চাঁদে পেশাব করে, তখন আমি রিকশা টানি। আর কিছু নৈতিক কোশ্চেনও আছে। এটা তো আসলে জিজ্ঞাসারই ব্যাপার নেই আর। ওই যে দেখছো টেপরেকর্ডারটা, ওটা কি খালি একটা জিনিসই, জাস্ট এ থিং?

রাইসু

না, এটার কাজও আছে।

শওকত

এটা ওই হয়ে গেল। বলো, এটা কী বলো?

রাইসু

এটা একটা শব্দগ্রাহক যন্ত্র।

শওকত

এর কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড নেই?

রাইসু

না, তাতো আছেই।

শওকত

তা কী? ব্যাকগ্রাউন্ড মানে কী?

রাইসু

ব্যাকগ্রাউন্ড মানে এটা কিভাবে তৈরি হলো, এটার ইতিহাস।

শওকত

ইতিহাস, হ্যাঁ। ইতিহাসেরও ইতিহাস। একটা জিনিস এমনিই এসে যায় নাকি? এই যে চাঁদে যায়, এমনিই চলে গেছে মানে, কী বলব, এই যে দাদার দাদা আছে, এটাই তো ভুলে যায়। আমাকে এখন আর উত্তেজিত কোরো না, ডাক্তার মানা করে দিয়েছে। হিউম্যান স্টুপিডিটি দেখলেই আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। যা ঘটে আর কি এখানে, ওগুলো নিয়ে তো কেউ প্রশ্নও তোলে না। একটা থিং নিজে থিং নাতো। বহুকালের সুদীর্ঘকালের সাধনা, তারপর একটা জিনিস আসে। গ্রাম্যতা কী, তুমি একটা জিনিস ব্যবহার করছো, কিন্তু জানো না। আমরা ইতিহাস দিয়ে বেষ্টিত নই? তোমার তো কনট্রিবিউশনই নেই গত সাতশো-আটশো বছরে। কিছুই নেই তোমার। আর ওই ঐতিহ্যের দিকে তাকিয়ে… “আমি এই আছিলাম, ওই আছিলাম!”

রাজু

আচ্ছা ওসমান ভাই, আপনি যে বললেন সাতশো-আটশো বছরে আমাদের কোনো কন্ট্রিবিউশন নেই, তাহলে তো মুসলমানদের সাতশো আটশ বছরের অতীত ব্লাঙ্ক। ভবিষ্যতে তাহলে কী হবে?

শওকত

ইতিহাসে তো আর রেডিমেড কিছু পাওয়া যায় না।

রাইসু

ওসমান ভাই, যদি আপনি বলেন মুসলমানদের সাতশো-আটশো বছরের অতীত ব্লাঙ্ক, তাহলে তো জাতি হিসাবে একটা শ্রেষ্ঠত্বের প্রশ্ন এসে যায়। মানে যারা জাতি হিসাবে ভাল কাজ করেছে, তাদের আমরা শ্রেষ্ঠ জাতি বলব?

শওকত

হ্যাঁ, সেই।

রাইসু

এটি বলার মাধ্যমে আমরা সম্প্রদায়িক কোনো কাজ করছি কিনা? জার্মানরা যে নিজেদের শ্রেষ্ঠ জাতি বলত…।

শওকত

না, সেটা থাকলেও ইতিহাসের কতগুলো ডিমান্ড আছে। সে ডিমান্ডর সাথে…।

রাইসু

ডিমান্ড ফুলফিল করতে পারবে কিনা সেটা তো অনেকটাই পরিবেশ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। মরুভূমিতে তো জাহাজ আবিষ্কার করা সম্ভব নয়।

শওকত

সেটাই সব নয়। পরিবেশ তো আছেই। পরিবেশের কনট্রিবিউশন নিশ্চয়ই থাকে। তবু আবার মানুষ।

রাইসু

টেকনোলজিক্যাল উন্নতিই কি সমস্ত উন্নতির স্মারক?

শওকত

টেকনোলজি ইজ ওয়ান অব দি ফ্যাক্টরস। সভ্যতার একটা বিশেষ ফ্যাক্টর।

রাইসু

টেকনোলজি ছাড়াই তো আদিবাসীরা বেঁচে আছে এবং তাদের জীবনযাত্রার মান আমাদের চেয়ে খারাপ আমরা বলতে পারি না।

শওকত

বাঁচে তো এজন্যে চল্লিশ বছর। কনট্রিবিউশনও তো কিছু নাই। তার শিল্প-সাহিত্যের পারম্পর্য…।

রাজু

আপনি লিনিয়ার ভাবে ইতিহাসকে দেখছেন বলে এটা বলছেন। কিন্তু ওরা তো হিস্ট্রির বাইরে। ইতিহাস যে লিনিয়ার, এই ধারণাটাই তো ওরা গ্রহণ করছে না।

শওকত

আমি বলছি যে, আদিবাসীরা তো সিভিলাইজডই হয়নি। আমরা যাকে সিভিলাইজেশন বলি আর কি, যেমন তার জ্ঞান-বিজ্ঞান শিল্প-সাহিত্য এগুলো হয়ত প্রিমিটিভ স্তরে থাকে ওদের।

রাজু

কিন্তু এখন তো এটা সম্পর্কে একটু বিতর্ক বা ভিন্নমত আছে।

শওকত

কারা করে জানো, যারা এগিয়ে গেছে। মধ্যযুগীয়তা ভাঙবার জন্যে ন্যাশনালিজম একটা বিরাট ফ্যাক্টর। অথচ তারাই আমাদের বলবে, তোমরা ন্যাশনালিস্ট হয়ো না!

রাজু

ঠিক আছে, আপনার কথা ঠিক আছে। কিন্তু আদিবাসীদের ওপর যে গবেষণাগুলো আলোচনাগুলো, ওরা দেখাতে চাচ্ছেন যে আমরা যেভাবে স্টেটের কল্পনা করি এরকম একটা কাঠামো ওদের মধ্যেও থাকে। ওদেরও তো একটা সোশ্যাল টাইপ আছে।

শওকত

ওরে ভাই, সেটা আছে, যেখানে হিউম্যান সিভিলাইজেশন এত অগ্রসর হয়ে গেছে…।

রাজু

আপনি সিভিলাইজেশনকে দেখতে চাচ্ছেন টেকনোলজিক্যাল উন্নতি দিয়ে?

শওকত

টেকনোলজি ইজ ওয়ান অব দি ফ্যাক্টরস, শুধু টেকনোলজি হলে তো হবে না।

রাজু

এখন আমি যদি বলি আমার টেকনোলজি আদৌ দরকার আছে কিনা?

শওকত

হতে পারে। হলে ঠিক আছে। সুইসাইডাল ম্যানিয়াও তো থাকে অনেক জাতের। যাদের বিজ্ঞানের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। সোজা বলা যায়, নিশিগ্রস্ত জাত।

রাইসু

আমরা সাহিত্যের মধ্যে আসি।

রাজু

সাহিত্যের দিক থেকে আপনি বাঙালি মুসলমানদের কোনো কনট্রিবিউশন দেখতে পান, সিগনিফিকেন্ট বা টাওয়ারিং কাউকে?

শওকত

টাওয়ারিং কোনো কিছু হয়ত হয়নি।

রাজু

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বা আপনার কথা বলা যায়।

শওকত

আজকাল ওয়ার্ল্ড স্ট্যান্ডার্ড নিয়ে বুঝতে হয়। আমরা তো লোকাল লায়ন হয়ে যাই—স্থানীয় সিংহ আর কি।

রাইসু

ওয়ার্ল্ড স্ট্যান্ডার্ড তো একটা রাজনীতিক ব্যাপার। ভাল হলেই ওরা বুঝবে কেন, স্বীকার করবে কেন? আমরা তো আর ইংরেজিতে লিখি নাই।

শওকত

ওয়ার্ল্ড স্ট্যান্ডার্ড মানে কী, তুমি নিজেই বুঝে যাবে। আমার ডাইরিতেই তার প্রমাণ আছে, বুঝেছো। নাইনটিন সেভেনটি সেভেনে, প্রথম যখন ‘হানড্রেড ইয়ারস অফ সলিচিউড’ পড়লাম, বললাম যে একে নোবেল পুরস্কার দেয়া উচিত। আরো আট বছর লাগল, দেরি হল। মানে আরো সাত বছর পরে পেলো আর কি। সেই যে একটা অদ্ভুত ব্যাপার তৈরি করে, সাংঘাতিক ক্ষমতা আছে।

রাজু

বোর্হেসের লেখাও বোধহয় আপনি সে সময় পড়েছেন।

শওকত

লোকটা পলিটিক্যালি কিন্তু ফ্যাসিস্ট।

রাজু

ফ্যাসিস্ট হলে সাহিত্যিকর্মে কী কী সমস্যা হতে পারে?

শওকত

ফ্যাসিস্ট হলেও সে কিন্তু সাহিত্যিক বড় হতে পারে। এজরা পাউন্ড-টাউন্ড আছে। সামাজিক সমস্যা হবে, কিন্তু নন্দনতাত্ত্বিক সমস্যা হচ্ছে না।

রাইসু

নন্দনতত্ত্ব তাহলে কি মোটামুটি অমানবিক একটা জিনিস?

শওকত

অমানবিক না।

রাজু

আমাদের এখানে কি এরকম কোনো নজির আছে যে বড় লেখক, রাজনীতিক আদর্শের জন্যে…।

শওকত

আমি এতে দুঃখ পাই আর কি। আমি বলি যে কার্সড রাইটার—অভিশপ্ত লেখক। আমি সচেতন হই বা না হই, আমরা যারা এ অবস্থায় আছি—আমি তো কাজ করি এথিকসের জন্যে। রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথকে কী করতে হয়েছে, কত সামাজিক কাজকর্ম করতে হয়েছে! বাঘাবাড়িতে গেলে, পাবনাতে আর কি, সেখানে যে গরুগুলো আছে—অনেকে ঠাট্টা করে বলে, রবীন্দ্রনাথের বংশধর।

রাইসু

আমার মনে হয় যদি কেউ ফ্যাসিস্ট হয় অসুবিধা নাই, কিন্তু যদি সাহিত্যের মধ্যে ফ্যাসিজম থাকে, তাহলে সমস্যার ব্যাপার।

রাজু

আচ্ছা, আমাদের এখানে যেটা দেখা গেল যে ‘মার্কসবাদী’–এরকম লেবেল মার্কা সাহিত্যের একটা ব্যাপার যে শুরু হয়েছিল, এটা কি স্বাভাবিক ছিল?

শওকত

যে-অবস্থায় কাজ করি, যে অবস্থার মধ্যে থাকি, সমাজের কথাটাই প্রথম কথা—আমরা যে দেশে বাস করি।

রাজু

তাহলে তো এদেশে বড় শিল্পী হওয়া সম্ভব নয় কখনও।

শওকত

এখন নেইও তো। রবীন্দ্রনাথের মত প্রতিভা—কিন্তু সারাজীবন লিরিকের ওপর কাজ করে গেলেন! আরো তো আছে সাহিত্যের। ইউরোপ থেকে আনলেন রোমান্টিক মুভমেন্টটা। ওখানে তো আরো মুভমেন্ট ছিল। যারা মননের ওপর কাজ করেছেন। তাহলে কি আর আমরা এই অবস্থায় থাকি? কুত্তার মত ঝগড়া মারামারি করি?

রাইসু

এত মননশীলতার চর্চার পরও কি ইউরোপে সাম্প্রদায়িক ঝগড়াঝাটি হয় না?

শওকত

আমাদের মত হয় না।

রাজু

বসনিয়ায় যেভাবে হচ্ছে।

শওকত

রাজনীতির অন্যান্য কন্ডিশনও তো আছে।

রাইসু

এসব থেকে তো মনে হয় সাহিত্য বা শিল্প মানুষের মননের উন্নতির জন্যে কিছুই করতে পারে না।

শওকত

করতে পারে। রবীন্দ্রনাথই এটা দেখিয়ে গেছেন। লিরিকের হাইয়েস্ট ফর্ম মিউজিক। আমাদের দুজন, আরেকজন নজরুল, যারা গ্রেট—দুজনেই এটা দেখিয়ে গেছেন। আর মিউজিক তো মননেরই জিনিস।

রাইসু

আচ্ছা, আমরা যে এখনও আমাদের সাহিত্যে ভারতীয় দাদাদের ছাপ পাই…।

শওকত

ছাপ পাই মানে কী? হঠাৎ হঠাৎ তো আর কেউ দ্রুত দিগদিগন্ত খুলে রবীন্দ্রনাথের মত ভেঙেচুরে এটা-ওটা করতে পারে না। আর যেহেতু সাহিত্যের উৎসটাও ছিল ওইখানে। মানে মডার্ন সাহিত্যের ব্যাপারটাই কলকাতাকেন্দ্রিক। সব ওখানেই। সব জায়গাতেই তাই। ইউরোপে অবশ্য আর অতটা নেই যে প্যারিসে না গেলে হবে না।

রাইসু

এটা এখনও কাটছে না কেন, কলকাতার যে হ্যাংওভার?

শওকত

আইডোলজিক্যালি যদি জোরদার কোনো কিছু এখানে গ্রো করত তাহলে এটা কেটে যেত তাড়াতাড়ি। মুক্তি কি এতই সহজ ভাই? ওই সোশ্যাল ইভলুশনটা কক্ষনোই তো হয় নাই।

জানুয়ারি ৪, ১৯৯৫, ঢাকা


শওকত ওসমানের সংক্ষিপ্ত পরিচয়

১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি হুগলির আরামবাগ মহকুমার সবলসিংহপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন শওকত ওসমান। পারিবারিক নাম ছিল শেখ আজিজুর রহমান। সে সময় আজিজুর রহমান নামে একজন পরিচিত কবি ছিলেন, তাই সাহিত্যজগতে আলাদাভাবে নিজেকে তুলে ধরতে তিনি লেখক নাম গ্রহণ করেন।

১৯৩৮ সালে লেখালেখি শুরু করেন ‘শওকত ওসমান’ নামে। এই নাম বেছে নেওয়ার পেছনে রয়েছে এক আবেগময় পারিবারিক গল্প—বড় বোন সুফিয়া খাতুন ভাইয়ের নাম রাখতে চেয়েছিলেন শওকত আলী, কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। ১৯৩১ সালে সুফিয়ার মৃত্যুর পর তার স্মৃতিকে ধারণ করতে ‘শওকত’ নামটি গ্রহণ করেন তিনি। আর ‘ওসমান’ পদবীটি নেন অল্প বয়সে প্রয়াত মেজচাচার নাম থেকে।

সপরিবারে শওকত ওসমান

পিতা মুহাম্মদ এহিয়াকে শওকত ওসমান স্মরণ করেছেন বহু প্রতিভাধর এক ‘সব কাজের কাজি’ হিসাবে। তিনি বলেন, “একাধারে রাজমিস্ত্রী, পালিশ মিস্ত্রি, এমনকি জাগতিক কাজের বাইরে মসজিদের ইমামের অভাবে সেই কাজ চালিয়ে নেয়া, ইহকালের কাজ তিনি ভাল জানতেন। নানা কাজের কাজি অথচ প্রায়শই পিতার সন্ন্যাসীসুলভ নির্বিকারত্ব আমাদের বিপদে ফেলত।” পিতা এহিয়া মৃত্যুবরণ করেন ১৯৪৮ সালে। তার মা গুলেজান বেগমের মৃত্যু হয় ১৯৭২ সালে।

শিক্ষাজীবনের সূচনা হয় মৌলবী আইনুদ্দিনের কাছে, এরপর শিক্ষক মোহাম্মদ আলীর নিকট। শওকত ওসমান বলেন, “বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন জন আমার ইমাম, মক্তবে ছিলেন মৌলবী আইনুদ্দিন। তিনি খুলনা জেলার অধিবাসী ছিলেন। তাঁর কাছেই আমার হাতেখড়ি। তাঁর স্নেহ আমাকে লেখাপড়ার দিকে আকৃষ্ট করেছিল। বছর তিনেক পর হঠাৎ তিনি চলে গেলেন। তাঁর স্মৃতি আমাকে বহুদিন আবিষ্ট রেখেছিলো।” এরপর তিনি ভর্তি হন নন্দনপুর হাইস্কুলে এবং পরে চলে আসেন নিজ গ্রামের সবলসিংহপুর মাদ্রাসায়। এখানকার শিক্ষক আবদুল হালিমের সহযোগিতায় তিনি কলকাতায় পড়াশোনার সুযোগ পান।

কলকাতায় মাদ্রাসা-এ-আলিয়ায় ভর্তি হন, পরে চলে আসেন অ্যাংলো পার্সিয়ান বিভাগে। ১৯৩৪ সালে ভর্তি হন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। টিউশনি করে নিজের খরচ চালাতেন এবং বাড়িতেও টাকা পাঠাতেন। এই সময় কলেজে সাহিত্য প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হন এবং ভবিষ্যতের প্রেরণার উৎস হয়ে ওঠেন হবীবুল্লাহ বাহার, যিনি পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম স্বাস্থ্যমন্ত্রী হন। তার সঙ্গে শওকতের ঘনিষ্ঠ সাহিত্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

মাত্র ১৫ বছর বয়সে শওকত ওসমানের প্রথম গল্প ও কবিতা প্রকাশিত হয়। যদিও পরে তিনি গদ্যকে বেছে নেন, কবিতার সৌন্দর্য ও তার পাঠাভ্যাস তার লেখালেখিতে সবসময়ই ছাপ রেখে গেছে। ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৩৮ সালে বিএ পাশ করেন। ওই একই বছরে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন সালেহা খাতুনের সঙ্গে।

তথ্যসূত্র ও ছবি : শওকত ওসমান ওআরজি