অন্নপূর্ণা দেবীর সাক্ষাৎকার
"রবি শঙ্কর আর দাদা আলী আকবর মিলে হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জন্য যতটুকু করেছেন, আমার পরিচিত আর কেউ ততটুকু করেননি।"
"রবি শঙ্কর আর দাদা আলী আকবর মিলে হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জন্য যতটুকু করেছেন, আমার পরিচিত আর কেউ ততটুকু করেননি।"
অন্নপূর্ণা দেবীকে (১৯২৭-২০১৮) দেখেছেন মাত্র কয়েকজন। প্রায় ৬০ বছর ধরে তিনি লোকচক্ষুর আড়ালে থেকেছেন।
১৯২৭ সালের ২৩ এপ্রিল ব্রিটিশ ভারতের মধ্য প্রদেশের মাইহারে জন্ম নেন তিনি। জন্মের পরে তার নাম রাখা হয়েছিল রওশন আরা বেগম। অল্প বয়সেই বাবা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ (১৮৬২-১৯৭২) এর কাছে সজ্ঞীতের তালিম নেন তিনি। আলাউদ্দিন খাঁ তার মেয়েকে সুরবাহার বাজানোর দিকে পরিচালিত করেন। সুরবাহার বাদ্যযন্ত্রটি এর ধীরতা ও গাম্ভীর্যের জন্যে বিখ্যাত। একই সঙ্গে এর বৃহৎ আকার এটিকে আয়ত্ত অসাধ্য করে রাখে।
বাবা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ হিন্দুস্তানী ধ্রুপদী সঙ্গীতের মাইহার ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা। ভাই ওস্তাদ আলী আকবর খান (১৯২২-২০০৯) ছিলেন ভারতের নামকরা সরোদ বাদক।
রওশনের যখন ১৪ বছর বয়স, বাবার ছাত্র সেতার বাদক রবি শঙ্করকে—বাবা আলাউদ্দিন খাঁর পূর্ণ সম্মতিতে—বিয়ে করেন তিনি। রবি শঙ্করের বয়স ছিল তখন ২১। তিনি আলাউদ্দিন খাঁর বন্ধু ও ভ্রমণসঙ্গী নৃত্যশিল্পী উদয় শঙ্করের ছোট ভাই।
বিয়ের দিনই (১৫ মে, ১৯৪১) রওশন হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করে “অন্নপূর্ণা” নাম নেন। পরের বছর তাদের একটি পুত্র সন্তান জন্মলাভ করে। তার নাম রাখা হয় শুভেন্দ্র শঙ্কর। বাল্যে শুভেন্দ্র ওরফে শুভকে অন্নপূর্ণা সেতার বাজানো শিখিয়েছিলেন।
রবি শঙ্করের সঙ্গে অন্নপূর্ণার সম্পর্ক বেশিদিন টেকেনি। সন্তান শুভও আর তার সঙ্গে থাকেননি। রবি শঙ্করের সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের পর অন্নপূর্ণা বোম্বে চলে যান।
রলি বুকস থেকে ২০০৫ সালে প্রকাশিত স্বপনকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা জীবনীগ্রন্থ ‘An Unheard Melody – Annapurna Devi‘ তে অন্নপূর্ণা বলেছেন, তার ছেলেকে যখন তার কাছ থেকে “কেড়ে নেওয়া” হয়েছিল, তখন অন্নপূর্ণার মনে পড়ছিল তার শৈশবের সেই মাংস বিক্রেতার কথা, একটি পাখি ঝাঁপিয়ে পড়ে তার হাত থেকে মাংসের টুকরা ছিনিয়ে নিয়েছিল।
বিচ্ছেদের অনেক দিন পরে, ১৯৮২ সালে, অন্নপূর্ণা তার ছাত্র ঋষিকুমার পাণ্ড্যকে বিয়ে করেন, বোম্বেতে। অন্তরালে থেকেই তিনি মুম্বাইয়ে ভারতীয় ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত শিক্ষা দিয়েছেন অনেক দিন।
তার বিখ্যাত শিক্ষার্থীদের তালিকায় আছেন হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া, নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, নিত্যানন্দ হলদিপুর, হিরেন রায়, রনু মজুমদার, আশিস খান প্রমুখ। অনেকে তাকে তার প্রথম স্বামী রবি শঙ্করের চেয়েও বড় মাপের সঙ্গীতজ্ঞ মানেন।
১৯৫০-এর দশকের শেষার্ধ্ব থেকে তিনি আর কখনো জনসমক্ষে যন্ত্র বাজাননি, তার বাজানোর পেশাদার রেকর্ডিং করতে দেননি এবং নিজের ছবি তুলতেও নিষেধ করে দিয়েছিলেন। এমনকি তিনি যখন ১৯৭৭ সালে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক পদ্মভূষণ লাভ করেন তখনও সে অনুষ্ঠানে যাননি, পুরস্কার তার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল।
গোপনে অবশ্য তার যন্ত্রসঙ্গীত রেকর্ড করা হয়েছে। তবে সে রেকডিং-এর মান ভাল ছিল না।
২০২২ সালের মে মাসে অন্নপূর্ণার নতুন একটি জীবনী (Annapurna Devi: The Untold Story of a Reclusive Genius) প্রকাশিত হয় পেঙ্গুইন থেকে। এই বইয়ের মুখবন্ধ লেখেন পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া (জন্ম. ১৯৩৮)। বইয়ের লেখক অতুল মার্চেন্ট। বোঝা যায়, অন্নপূর্ণা, রবিশঙ্কর ও আলাউদ্দিন খাঁ পরিবারের অনেক অনালোচিত বিষয় জানার ক্ষেত্রে অন্নপূর্ণার শিক্ষার্থীরা অতুলকে প্রভূত সাহায্য করেন। এমন অনেক বিষয় এসেছে বইটিতে যা এর বাইরের কোনো সূত্র থেকে জানা সম্ভব ছিল না।
তিন সন্তান রেখে অল্প বয়সে নিউমোনিয়ায় মারা গিয়েছিলেন অন্নপূর্ণা ও রবি শঙ্করের ছেলে শুভ। শুভ ও রবি শঙ্করের মধ্যে সম্পর্ক ভাল ছিল না। অতুল মার্চেন্টের বইয়ে এই বিষয়ে কথাবার্তা আছে। শুভেন্দ্র পিতা রবি শঙ্করের সঙ্গে শেষের দিকে ডুয়েট বাজাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।
১৩ অক্টোবর ২০১৮ শনিবার স্থানীয় সময় ভোর ৩টা ৫১ মিনিটে মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে অন্নপূর্ণা দেবী মৃত্যুবরণ করেন।
মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। কয়েক বছর ধরেই বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি।
এখানে প্রকাশিত অন্নপূর্ণা দেবীর সাক্ষাৎকারটি তার মৃত্যুর ৪ বছর আগে ২০১৪ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রকাশিত হয় টাইমস অব ইন্ডিয়ায়।
তথাগত রায় চৌধুরীর নেওয়া সাক্ষাৎকারে এসেছে রবি শঙ্করের সাথে তার ব্যর্থ সংসার জীবন, রবি শঙ্করের শিল্পশৈলী, মাইহার ঘরানা এবং ভারতীয় সঙ্গীতে তার পিতা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর অবদানের মত গুরুত্বপূর্ণ আলাপ।
তথাগত রায় চৌধুরী
অন্নপূর্ণাজী, প্রথমে জানতে চাইব, কোন ব্যাপারটি আসলে রবি শঙ্করজীকে “রবি শঙ্কর” করে তুলেছিল?
অন্নপূর্ণা দেবী
দেখুন তথাগত, রবি শঙ্কর ছিলেন সব থেকে পূর্ণাঙ্গ সেতারবাদক, যার ডান-বাম দুই হাতের বাজানোতেই ছিল সমান নিয়ন্ত্রণ… অন্তত শুরুর দিকের দিনগুলিতে। আর প্রাচীন ধ্রুপদী সেতার বাজাতে হলে এই দক্ষতার কোনো বিকল্প ছিল না।
উনার বাজানোর একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য দেখবেন—রাগ এর বিশুদ্ধতা। উনি যে রাগই বাজাতেন না কেন—বিশুদ্ধ ভাবে বাজাতেন। ধ্রুপদ-অঙ্গ এর আলাপ আর জোড় , বিভিন্ন তাল এর ওপরে পরিপূর্ণ দখল, কৃন্তন, জামজামা আর বোল এর অসাধারণ ব্যবহার রবি শঙ্করেরকে আলাদা করে তুলেছিল। পণ্ডিতজী আর আমার ভাই আলী আকবর খাঁ দুজনেই আমার বাবা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সরাসরি ছাত্র। বাবার থেকে তালিম নিয়ে রবি শঙ্কর আর আলী আকবরই প্রথম সুনির্দিষ্ট নিয়মে ধ্রুপদ ঢঙের অতিদীর্ঘ আলাপ, জোড় আর ঝালা বাজাতে শুরু করেন। অন্যান্য ঘরানার বাজিয়েরা যেটা পরে অনুসরণ করলেন। রবি শঙ্কর আর দাদা আলী আকবর মিলে হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জন্য যতটুকু করেছেন, আমার পরিচিত আর কেউ ততটুকু করেননি। উনারা দুইজনই সর্বপ্রথম হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে বিশ্বের কাছে জনপ্রিয় করে তোলেন।
তথাগত
কিন্তু, বাইরের বিশ্বের কাছে হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে তুলে ধরতে গিয়ে, রবি শঙ্করজী কি সঙ্গীতের মানের জায়গায় আপস করতে বাধ্য হননি?
অন্নপূর্ণা
হ্যাঁ। হয়েছেন; শুরুর দিকে।
তথাগত
কী ধরণের আপস?
অন্নপূর্ণা
যে রাগগুলি উনি অনায়াসে গভীরভাবে বাজাতে পারতেন, অনেক বেশি ভেতরে ডুব দিতে পারতেন, বিদেশের মঞ্চে বাজানোর সময় সেগুলির অত গভীরে যাওয়ার সুযোগ উনার হত না। এছাড়াও উনি ধীরে ধীরে তবলাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া শুরু করলেন। এই সময়টাতেই আনুষঙ্গিক অনেক কিছুর প্রভাবে—গভীর, ধ্যানমগ্ন সুরের যে অনুসন্ধান উনার মধ্যে ছিল সেটা ফিকে হওয়া শুরু করল। তিনি সওয়াল-জবাব এর প্রচলন ঘটালেন। যেটা হয়ত সঙ্গীতকে সমৃদ্ধ করেছিল, কিন্তু কাদের জন্য?—সঙ্গীতের ব্যাপারে যারা নিতান্তই আনাড়ি তাদের জন্য।
অনুবাদ: সাব্বির পারভেজ সোহান
এছাড়াও উনি দক্ষিণ ভারতের রাগগুলির দিকে অতিমাত্রায় ঝুঁকে গেলেন। যেগুলি কিনা অধিকাংশ সময়েই, পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, হিন্দুস্তানি সঙ্গীতের থেকে অনেক আলাদা। এরপরেও, হিন্দুস্তানি ক্লাসিক্যাল মিউজিকে উনি অনেক নতুন ব্যাপার চালু করেছিলেন, যেগুলি বিশ্বের কাছে আমাদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে জনপ্রিয় করে তুলতে উনাকে সাহায্য করেছিল।
তথাগত
রবি শঙ্করজীর ধরনে সেতার বাজানোর ক্ষেত্রে আপনি কাকে উত্তরসূরি বলতে চান?
অন্নপূর্ণা
সেভাবে উনার যোগ্যতার সমান তো কেউ নেই। তবে, আমাদের মাইহার ঘরানার কয়েকজন সেতারী আছেন যারা বেশ ভাল বাজান।
তথাগত
পণ্ডিতজীর আত্মজীবনী যিনি লিখলেন, শংকরলাল ভট্টাচার্য, একটা বাংলা খবরের কাগজে তিনি লিখেছিলেন যে ‘রাগ অনুরাগ’ বইয়ে আপনার কথা বলার সময় রবি শঙ্করজী প্রায় কেঁদে ফেলার উপক্রম ঘটান। পণ্ডিতজী কি এই ধরনের কোনো কথা আপনাকে কখনো বলেছেন?
অন্নপূর্ণা
উহু; না। আমার এই ধরনের কোনো কথা মনে পড়ে না।
তথাগত
আপনাদের ছেলে শুভ। আপনাদের দুইজনের সমস্ত তালিম পাওয়ার সৌভাগ্য সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর তিনি সেতার বাজানোই বন্ধ করে দিলেন। আপনারা তো মনেপ্রাণে চাইতেন শুভও নিজেকে সেতারবাদক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করুক। সমস্যাটা কোথায় ছিল এইক্ষেত্রে?
অন্নপূর্ণা
মূলত, শুভর সমস্যাটা ছিল ওর বাবার সাথে। ওর তালিমের শেষের দিকে, শুভ তো পণ্ডিতজীর সাথে সুস্থভাবে কথা বলার অবস্থায় পর্যন্ত ছিল না। আমি নিজেও জানি না বাবা আর ছেলের মধ্যে কী ঘটেছিল। কোনো ধারণাই নেই আমার এই ব্যাপারে। শুভর যখন যুক্তরাষ্ট্রে থাকা অবস্থায় অসুখ করল, পণ্ডিতজী তখন লন্ডনে। অথচ, তখনও তিনি আমাকে বললেন আমি যেন অতিসত্বর ক্যালিফোর্নিয়া যাই, শুভর দেখাশোনা করি। কিন্তু, আমার তো কোনো পাসপোর্টই ছিল না। কীভাবে যেতাম আমি, বলুন?
তথাগত
শুভর ছেলে সোম শঙ্কর আর মেয়ে কাবেরির ব্যাপারে কী বলবেন? যদিও ওদের বেড়ে ওঠা যুক্তরাষ্ট্রে, কিন্তু ওদের কি কখনো ইচ্ছা হয়নি নিজেদের শেকড় অনুসন্ধানের? আপনার কাছ থেকে সঙ্গীতের শিক্ষা গ্রহণের?
অন্নপূর্ণা
আমি জানি না। ওদের সাথে সেভাবে কোনো যোগাযোগ কখনোই ছিল না। শুভর মেয়ে কেবল একবার আমাকে দেখতে এসেছিল। তিনদিন মত ছিল সে এখানে; তাও সেটা শুভর মৃত্যুর পর। ভরতনাট্যম শিখছিল ও তখন।
তথাগত
রবি শঙ্করজী আর আপনার বিচ্ছেদের ব্যাপারে আপনার ভাই ওস্তাদ আলী আকবর খাঁর প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
অন্নপূর্ণা
উনি অসন্তুষ্ট ছিলেন। এইটুকুই। তিনি না আমার দিকে ছিলেন, না পণ্ডিতজীর দিকে। আমাদের ছাড়াছাড়ির ব্যাপারটা দাদার ভাল লাগেনি। কিন্তু, তার হাতে তো কিছু করার ছিল না।
তথাগত
রবি শঙ্করজীকে কি উনি এ নিয়ে কিছু বলেছিলেন?
অন্নপূর্ণা
আমি একদমই জানি না। এসব তো বহু আগের ঘটনা।
তথাগত
আপনার বাবা, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ—যিনি পণ্ডিত রবি শঙ্করেরও গুরু—উনার প্রতিক্রিয়া কী ছিল আপনাদের ছাড়াছাড়িতে?
অন্নপূর্ণা
বাবা অনেক আঘাত পেয়েছিলেন। গভীর দুঃখ হয়েছিল উনার। বাবা হয়ত পণ্ডিতজীকে কিছু বলে বোঝানোর চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু—কাজ হয়নি।
তথাগত
কিন্তু আপনার বাবার সাথে রবি শঙ্করজীর সুসম্পর্ক বজায় ছিল কিনা?
অন্নপূর্ণা
বাবার জন্য উনার যতটুকু সাধ্য ছিল উনি করেছিলেন। চূড়ান্ত গুরু শ্রদ্ধা ছিল উনার।
তথাগত
‘মুখোমুখি রবি শঙ্কর’ বইয়ে, পণ্ডিতজী স্বীকার করেছিলেন যে আপনার সাথে সংসার করতে না পারাটা উনার নিজের ব্যর্থতা ছিল…।
অন্নপূর্ণা
দেখুন, এই নিয়ে আমি কী বলব? ওসবের পরে এতটা সময় চলে গেছে, এতগুলি দশক। আর, এই ব্যাপারে আমি এখন নিশ্চুপ থাকতে চাই।
তথাগত
আপনার মতে হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর অবদান কী?
অন্নপূর্ণা
শাস্ত্রীয় যন্ত্রসঙ্গীতের কথা যদি বলি, ভারতবর্ষের ইতিহাসে উনার অবদান সবথেকে বেশি। উনাকে তো হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় যন্ত্রসঙ্গীতের জনকও বলা হয়ে থাকে। এমনকি অন্যান্য ঘরানার সঙ্গীতজ্ঞরাও উনাকে “বাবা” বলেই সম্বোধন করতেন।
আপনি কেবল মাইহার ঘরানাতেই বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের এতজন মায়েস্ত্রোকে একসঙ্গে পাবেন। বাঁশিতে, পণ্ডিত পান্নালাল ঘোষ সরাসরি বাবার ছাত্র ছিলেন। আমার কাছে তালিম নিয়েছেন পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া, পণ্ডিত নিত্যানন্দ হলদিপুর। পণ্ডিত রঘুনাথ শেঠ, পণ্ডিত বিজয় রাঘব রাও, পণ্ডিত দেবেন্দ্র মুর্দেশ্বর এবং পণ্ডিত রনু মজুমদার সকলেই এনারা মাইহার ঘরানার। অন্যতম গুণী বেহালা-শিল্পী, পণ্ডিত ভি জি যোগ, বাবার কাছ থেকে শিখেছেন।
তিমির বরণ, অসংখ্য বাংলা চলচ্চিত্রের সঙ্গীত করেছেন যিনি, উনিও বাবার ছাত্র। সঙ্গীত পরিচালক রোশান, হৃত্বিক রোশানের দাদা, তিনিও বাবার কাছ থেকে শিখেছেন। আরেকজন সঙ্গীত পরিচালক, জয়দেব, আল্লাহ তেরো নাম, ঈশ্বর তেরো নাম বলে অসাধারণ ভজনটার সঙ্গীত যার করা, সেও আমার দাদা আলী আকবর খাঁর শিক্ষার্থী। আর ডি বর্মণও দাদার কাছে তালিম নিয়েছেন। পণ্ডিতজী, দাদা, আমার চাচাতো ভাই ওস্তাদ বাহাদুর খাঁ, ভাতিজা আশিস (ওস্তাদ আশিস খাঁ) এবং আমার ছাত্র হরি—সকলেই এনারা বিভিন্ন বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। আমাদের ঘরানার প্রভাব কেবল শাস্ত্রীয় সঙ্গীতেই না, সেমি-ক্লাসিক্যাল আর ফিল্ম মিউজিকেও বিস্তৃত হয়েছিল। লোকগান থেকে ধ্রুপদ এবং পাশ্চাত্যের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতসহ সঙ্গীতের বিভিন্ন শাখা সম্বন্ধে বাবার জ্ঞান এতটাই প্রখর ছিল যে সঙ্গীত সংক্রান্ত যেকোনো ব্যাপার উনি অতি সহজে ধরতে পারতেন। আর হয়ত এসকল কারণেই, খ্যাতনামা একটা ম্যাগাজিন উনাকে বিংশ শতাব্দীর সব থেকে প্রভাবশালী ২০ জন ব্যক্তির একজন হিসেবে ভূষিত করেছে।
তথাগত
আপনি উল্লেখ করলেন যে, যন্ত্রসঙ্গীতে ভারতবর্ষে আপনার বাবার অবদান সব থেকে বেশি। কথাটাকে কি আপনি আরো একটু সুনির্দিষ্ট করবেন? অর্থাৎ, জানতে চাইছি যে, ঠিক কোন ব্যাপারগুলির কারণে উনার ভূমিকা আপনি সব থেকে বেশি মনে করেন? একদম সুনির্দিষ্ট ভাবে উনার উল্লেখযোগ্য অবদান আসলে কোনগুলি?
অন্নপূর্ণা
ব্যাপারটাকে দুইদিক থেকে ব্যাখ্যা করা যায়। প্রথমত, সঙ্গীতের বিভিন্ন ধারা থেকে উনি যা কিছু শিখেছিলেন, নিজের মধ্যে গ্রহণ করেছিলেন—বিশেষত ধ্রুপদ—সেদিক থেকে। আর দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রে উনি যেসব পরিবর্তন এনেছিলেন, যেসব পরিবর্তনের কারণেই মূলত দীর্ঘ কলেবরের সঙ্গীতগুলি বাজানো সম্ভব হয়ে উঠেছিল।
সঙ্গীতের ব্যাকরণের জায়গায় উনার অবদান হল—অতি দীর্ঘ এবং ধীর গতির আলাপ, বিস্তৃত জোড় এবং ঝালা’র প্রচলন। বিভিন্ন রকমের তাল এ বান্দিশ অথবা গাট রচনা করেন বাবা-ই; এর আগে প্রায় শুধুমাত্র তিন তাল এ সরোদ আর সেতারে গাট বাজানো হত। এছাড়াও বাবা তাল আর লয়কারীতে বৈচিত্র্য আনেন। হিন্দুস্তানি যন্ত্রসঙ্গীতের অন্যান্য যত ঘরানাই আপনি বর্তমানে শুনবেন, সবখানেই বাবার প্রভাব খুঁজে পাবেন।
আরো দেখুন, সেতার আর সরোদে বাবা যে পরিবর্তনগুলি এনেছিলেন সেগুলির কারণেই যন্ত্র দুটি তাদের নতুন রূপে পৌঁছতে পেরেছিল। বাবা আর তার ভাই ওস্তাদ আয়াত আলী খাঁ (সঙ্গীত ভবন, বিশ্ব-ভারতীর শিক্ষক) মিলে সেতার আর সরোদে পরিবর্তন আনার পরেই কিন্তু এই দুই বাদ্যযন্ত্রে পূর্ণাঙ্গ, পদ্ধতিগত এবং সুবিস্তৃত ধ্রুপদ-ঘরানার সঙ্গীত বাজানো সম্ভব হয়েছিল।
বাবার আগে, বাদ্যযন্ত্রে এরকম বিস্তারিত ও সংহত আলাপ-এর কাজ করা সম্ভব ছিল না। প্রকৃতপক্ষে, বীণ এর নানা ধরন আর খারাজ-লারাজ এর নিনাদ এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ দীর্ঘ আলাপ সেতার বা সরোদে বাজানোর উপায়ই ছিল না। আলাপ বাজানোর জন্য সেতার বানানোই হত না। আলাপ-এর জন্য সবাই ব্যবহার করতেন সুরবাহার, সেতারে বাজানো হত গাট।
তথাগত
তাহলে, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর আগে কীভাবে সেতার এবং সরোদ বাজানো হত?
অন্নপূর্ণা
সেতারে মূলত ছিল ওস্তাদ বিলায়েত খাঁ সাহেব আর তার পরিবারের বাজানোর ধরন। সরোদে, কেবল বাবা আর ওস্তাদ হাফিজ আলী খাঁ সাহেবের (ওস্তাদ আমজাদ আলী খাঁ’র পিতা) ধরন। উনারা দুইজনই রামপুরের ওস্তাদ ওয়াজির আলী খাঁ’র শিক্ষার্থী। দুইজনই অত্যন্ত খ্যাতিমান ছিলেন। কিন্তু, বাবার যেসব নিজস্ব উদ্ভাবন, পরিবর্তন সেগুলি বাদ্যযন্ত্রগুলিতে একধরনের গুণগত পরিবর্তন এনেছিল।
তথাগত
ওস্তাদ আলাউদ্দিন আলী খাঁ আর ওস্তাদ হাফিজ আলী খাঁ’র বাজানোর ঢঙে পার্থক্য কী ছিল?
অন্নপূর্ণা
যেমনটা আমি আগেই বলেছি, বাবার উদ্ভাবনের আগে আলাপ কখনোই এত সুবিস্তৃত ছিল না, গাট-এর এত বৈচিত্র্যও কখনো দেখা যায়নি। আপনি প্রথমে ওস্তাদ হাফিজ আলী খাঁ সাহেবের বাজানো শুনুন, এরপর বাবা এবং তার শিষ্যদের বাজানো শুনুন। দুইজনের সঙ্গীতশৈলী, বাজানোর ঢঙের পার্থক্য আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন। উনাদের রেকর্ডিংগুলিই উনাদের হয়ে কথা বলবে।
তথাগত
কিন্তু একজন বিখ্যাত সরোদ মায়েস্ত্রো, রবি শঙ্করজীর মৃত্যুর পর একটি বাংলা পত্রিকায় লিখেছিলেন যে পণ্ডিতজীর সেতার বাজানোর কায়দা সরোদ বাজানোর কৌশল দ্বারা প্রভাবিত ছিল, যেহেতু উনি একজন সরোদ গুরুর কাছ থেকে তালিম নিয়েছিলেন…
অন্নপূর্ণা
কিছু লোকজন ক্রমাগত এধরনের কথাবার্তা ছড়াতেই থাকেন। পণ্ডিতজী স্বয়ং উনার আত্মজীবনী ‘রাগ অনুরাগ’-এ উল্লেখ করেছেন অন্যান্য ঘরানার যেসকল মানুষজন উনার জনপ্রিয়তার ব্যাপারে ঈর্ষাকাতর ছিলেন, তারাই এইসকল কথা রটানোর চেষ্টা করতেন যে উনি সরোদের ঢঙে সেতার বাজান। কিন্তু এই যদি হয় আলাপের বিষয়, তাহলে আপনি কি এটা বলবেন যে আমি নিজে সরোদের ঢঙে সুরবাহার বাজিয়েছি বা হরি কিংবা নিত্যানন্দ সুরবাহারের ঢঙে বাঁশি বাজিয়েছে, যেহেতু ওরা আমার কাছ থেকেই শিখেছে, বলুন? হাস্যকর!
এমনকি সঙ্গীত সমালোচক নিলক্ষা গুপ্ত ২০১৩ সালে দেশ পত্রিকায় এসব অপবাদকে ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি এ কথাও উল্লেখ করেছেন, যদিও বাবা সরোদ বাজাতেন, পাশাপাশি উনি প্রাচীন, মূল ধ্রুপদী সেতার বাজ-এর কলাকৌশলের সুদক্ষ পণ্ডিত ছিলেন। আর আমি, পণ্ডিতজী, আমার দাদা—আমাদের গুরু তো স্বয়ং বাবা’ই। সুতরাং, এর বেশি আমি আর কী বলব?
তথাগত
তবুও অন্নপূর্ণাজী, উনাদের এই অভিযোগগুলি…
অন্নপূর্ণা
যে বাজ সেতারের শিক্ষা পণ্ডিতজী আর আমি অনুসরণ করেছি, আমার মতে সেটাতে দুই হাতের কাজের সবথেকে ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবহার ছিল। এবং, ওই বাজই বহুকাল ধরে সর্বোৎকৃষ্ট মানদণ্ড হিসেবে গৃহীত ছিল।
আর হ্যাঁ, সঙ্গীতের ব্যাকরণ কিন্তু মূলত এক। একটা নির্দিষ্ট অংশকে একটা নির্দিষ্ট বাদ্যযন্ত্রে আপনি কীভাবে বাজাবেন সেটার আলাদা কৌশল হয়ত আছে। কিন্তু, বাবা সেসকল কৌশল জানতেন। যদিও উনি আজীবন মূলত সরোদ বাজিয়েছেন, কিন্তু অনেক রেকর্ডিং পাবেন যেখানে বাবা বেহালা আর সুরশৃঙ্গার বাজিয়েছেন। উনি অনায়াসে সেতার, তবলা এবং আরো অনেক বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারতেন।
তথাগত
রবি শঙ্করজী আর নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় দুজনেই ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র কাছে তালিম নিয়েছেন। তবুও দুজনের বাজানোর ঢঙে এত পার্থক্যের কারণ কী?
অন্নপূর্ণা
কারণ, বাবা উনাদেরকে আলাদা ভাবে শিখিয়েছিলেন তাই। বাবা নিখিলকে পণ্ডিতজীর আরেকটা হুবহু ‘নকল’ হিসেবে তৈরি করতে চাননি, যেটা কিনা নিখিল ছিল যখন সে বাবার কাছে শিখতে এসেছিল। দুজন আলাদা শিক্ষার্থীকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে গড়ে তোলার তালিম বাবার মধ্যে ছিল। এই ব্যাপারটা উনার অত্যন্ত স্বতন্ত্র। আমার দিক থেকে বলব, আমি নিজেও চেষ্টা করেছি হরিপ্রসাদ আর নিত্যানন্দকে সম্পূর্ণ আলাদা কায়দায় শেখাতে। দুজনেই পণ্ডিত। কিন্তু আমি এটাই নিশ্চিত করেছি যে একজন যেন আরেকজনের ছায়া না হয়ে ওঠে।
যদিও, নিখিল অবশ্য ওস্তাদ আমির খাঁ’র দ্বারাও প্রভাবিত ছিল।
তথাগত
কোন ব্যাপারগুলি আলী আকবর খাঁকে—“আলী আকবর খাঁ” হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল?
অন্নপূর্ণা
বিশুদ্ধ রাগদারি, উদ্ভাবন, অবিশ্বাস্য লয়কারী, অতুলনীয় সৃষ্টিশীলতা।
তথাগত
বর্তমানের সঙ্গীতশিল্পীদের কাজের সাথে আপনি পরিচিত কিনা? কাউকে আপনার প্রতিভাবান মনে হয়েছে কিনা?
অন্নপূর্ণা
আমি রেডিওতে প্রায়ই সঙ্গীতবিষয়ক অনুষ্ঠানগুলি শুনি। অনেকেরই বাদ্যযন্ত্রের ওপর ভাল দখল রয়েছে। কিন্তু সঙ্গীতের ভেতরের জানটা সেখানে প্রায়ই অনুপস্থিত।
তথাগত
তাদের কেউ যদি আপনার কাছে শিক্ষা নিতে আসে?
অন্নপূর্ণা
শেখানোর মত বয়সে আমি আর নেই।
তথাগত
কোন কোন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পীর কাজ আপনার শুনতে ভাল লাগে?
অন্নপূর্ণা
বাবা আমাকে, দাদাকে এবং উনার শিষ্যদেরকে উনার নিজের সঙ্গীতের বাইরে আর কারোর সঙ্গীত শোনার অনুমতি দিতেন না। কিন্তু পরবর্তীতে আমি ওস্তাদ আমির খাঁ সাহেব, ওস্তাদ আবদুল করিম খাঁ সাহেব, পণ্ডিত ভীমসেন যোশী’র সঙ্গীত শুনি এবং তাদের কাজ আমার ভাল লাগে।
তথাগত
আনুশকা শঙ্কর-এর ব্যাপারে কী বলবেন?
অন্নপূর্ণা
পণ্ডিতজী ওর ব্যাপারে কঠোর পরিশ্রম করেছেন। আনুশকা মেধাবী।
তথাগত
নোরাহ জোনসের গান আপনার ভাল লাগে?
অন্নপূর্ণা
আমি ওর গান শুনেছি এবং ওর গায়কী আমার পছন্দের।
তথাগত
ক্লাসিক্যালের বাইরে, আর কোন ধরনের গান আপনার শোনা হয়?
অন্নপূর্ণা
সবধরনের ভাল গানই আমি শুনি, বলিউড থেকে শুরু করে আবিদা পারভিন। এ আর রহমানের কিছু গান আমি ভালবাসি। ‘যোধা আকবর’-এর ‘খাজা মেরে খাজা’ গানটা অনেক প্রিয় আমার।
তথাগত
অন্নপূর্ণাজী, এমন কোনো বার্তা আছে কি নিজের ব্যাপারে যা আমাদের মাধ্যমে প্রকাশ করতে চান?
অন্নপূর্ণা
আমার নিজের ব্যাপারে সেভাবে কিছু নেই। কিন্ত, আমার বাবার অনেক রেকর্ডিং অল ইন্ডিয়া রেডিওতে পড়ে রয়েছে। সেসবের মাত্র অল্প কয়েকটা প্রকাশিত হয়েছে। আমি সরকারকে অনুরোধ করব, দয়া করে যেন বাকি সমস্ত রেকর্ডিংগুলি প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়। এতে করে সঙ্গীতের সমঝদার, সঙ্গীত অনুরাগীদের উপকার হবে। বাবার রেকর্ডিংগুলি জাতীয় সম্পদ এবং সেগুলির অভিজ্ঞতার অধিকার সকলের।
অন্নপূর্ণা দেবীর শেষ সাক্ষাৎকার:
১৯৫০-এ অন্নপূর্ণা দেবীর সুরবাহার বাদন; রাগ, কৌশী কানাড়া:
১৯৫৩ সালের ডিসেম্বরে কলকাতার রনজি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত একটি কনসার্টে অন্নপূর্ণা দেবীর পাবলিক পারফরমেন্স; রাগ, মনোজ খামাজ: